তারুণ্যের জয়যাত্রা এগিয়ে চলুক

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

বাংলাদেশের কিশোর-তরুণদের নানা সাফল্যের বছর হিসেবে ২০১৮ সালটিকে আমাদের মনে রাখতে হবে। এ বছরটিতেই বাংলাদেশ বেশ বড় একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে। গত জুলাইয়ে রোমানিয়ার ক্লুজ নাপোকা শহরে অনুষ্ঠিত ৫৯তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের জন্য প্রথম সোনার পদকটি পেয়েছেন চট্টগ্রামের আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী। ১৯৫৯ সাল থেকে শুরু হওয়া হাইস্কুলের কিশোরদের গণিত অলিম্পিয়াডকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ মেধার লড়াই। সেটিতে আমাদের শিক্ষার্থীরা তাদের লড়াই শুরু করে ২০০৫ সালে। ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংক ও প্রথম আলোর পৃষ্ঠপোষকতায় এই আয়োজনের উদ্যোগ বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির। অংশগ্রহণের ১৪তম বারে এই সোনার পদক। ১০০টির বেশি দেশ অংশ নেয়—এমন যেকোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে বাংলাদেশের এটিই প্রথম সোনার পদক অর্জন। এ পদকের গুরুত্ব বোঝা যায় যখন আমরা জানি, ৫৯টি আসরে অংশ নেওয়া বিশ্বের ১৩৮টি দেশের মধ্যে ৭১টি দেশ এখনো কোনো সোনার পদক পায়নি।

আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরীর শুরু করা সাফল্য অব্যাহত থাকে আন্তর্জাতিক পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াড (চারটি ব্রোঞ্জ), ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড (একটি রুপা ও একটি ব্রোঞ্জ), আর্থ সায়েন্স অলিম্পিয়াড (একটি রুপা ও দুটি ব্রোঞ্জ), বায়োলজি অলিম্পিয়াড (একটি ব্রোঞ্জ) ও জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াডে (দুটি রুপা ও চারটি ব্রোঞ্জ পদক)। এসব সাফল্যকে ছাড়িয়ে দেশকে আবার আনন্দে ভাসায় ফিলিপিনের ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে আমাদের খুদে রোবট-বিজ্ঞানীদের সাফল্য। ২০ বছর ধরে হওয়া আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করে সোনার পদক নিয়ে আসে। সেখানে ক্রিয়েটিভ ক্যাটাগরিতে জুনিয়র বিভাগে স্বর্ণপদক পেয়েছে ম্যাপললিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. মেহের মাহমুদ এবং চিটাগাং গ্রামার স্কুলের (ঢাকা) ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী তাফসীর তাহরীম ও কাজী মোস্তাহিদ লাবিবের দল রোবো টাইগার্স। এই কিশোরদের পূর্বসূরিরা এ বছর বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন এমআইটি, প্রিন্সটনে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে রওনা হয়েছে। বৃষ্টি শিকদারের মতো কেউ কেউ পড়াশোনার পাট চুকিয়ে যোগ দিয়েছেন গুগলের কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার জগতে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্যের পাশাপাশি দেশেও তরুণেরা তাঁদের কার্যক্রমে আলো ছড়িয়েছেন। বিশেষ করে যাঁরা চাকরি না খুঁজে চাকরি দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তাঁদের উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে। দেশি মোটরসাইকেল রাইড শেয়ারিং উদ্যোগ ‘পাঠাও’-এর মাধ্যমে তারুণ্যের কর্মসংস্থান দেড় লাখ ছাড়িয়েছে ২০১৮ সালে। এ বছরই হুসাইন এম ইলিয়াসের ‘পাঠাও’ দেশের প্রথম স্টার্টআপ উদ্যোগ হিসেবে নিজেদের বাজারমূল্য ১০০ মিলিয়ন ডলার পার করেছে। গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্যসংক্রান্ত একটি অভিযোগও এ বছর পাঠাওয়ের বিরুদ্ধে উঠেছে। পাঠাওয়ের মতো আরও বেশ কিছু স্টার্টআপ উদ্যোগ এ বছর বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। এর মধ্যে মালিহা এম কাদিরের নেতৃত্বে সহজ ডট কম এবং সিফাত সারোয়ারের শপ-আপের বিস্তৃতিও অনেক বেড়েছে। এ বছরই বাংলা ভাষায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিউটি পোর্টাল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে সিনথিয়া শারমিন ইসলামের সাজগোজ ডট কম। স্টার্টআপদের এ সাফল্য দেশে তাঁদের জন্য ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে ভালো ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা যায়।

তবে তরুণ উদ্যোক্তাদের এসব সাফল্য ম্লান হয়, যখন জানা যায় দেশে নতুন উদ্যোগ গড়ে তোলা ও ব্যবসা সচল রাখা, এমনকি আফগানিস্তানের চেয়েও কঠিন। বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা পরিচালনা সূচক ২০১৮-এ বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়ে ১৭৬তম হলেও দেখা যায়, আফগানিস্তান ১৬ ধাপ এগিয়ে ১৬৭তম অবস্থানে চলে এসেছে। এই সূচকটি মনে করিয়ে দিয়েছে, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে শুধু উন্নতি করাই যথেষ্ট নয়, অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নতি করতে না পারলেও পিছিয়ে পড়তে হয়। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য এবারের বাজেট বক্তৃতায় সবচেয়ে আশার বিষয় ছিল ‘ভার্চ্যুয়াল বিজনেস’-এর স্বীকৃতি। কিন্তু বছর শেষে, ব্যবসা শুরু করার ট্রেড লাইসেন্স আইনে তার প্রতিফলন হয়নি। শুধু ইন্টারনেট, ল্যাপটপভিত্তিক যে ব্যবসা নিজের রুমে বসে করা যায়, তার জন্য ‘নির্দিষ্ট বর্গফুটের অফিস’ এখনো ‘বাধ্যতামূলক’ই রয়ে গেছে।

সাফল্যের পাশাপাশি তরুণদের হতাশার কথা জানা গেছে কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়–শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার সংবাদে। বিগত সাত বছরে দেশে বেকারত্বের হারও দ্বিগুণ হয়েছে বলে জানা গেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আঞ্চলিক কর্মসংস্থান নিয়ে প্রতিবেদন ‘এশিয়া-প্যাসিফিক এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’-এ। দেখা যাচ্ছে, উচ্চশিক্ষা এখন আর কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। তরুণেরা যত বেশি পড়ালেখা করছেন, তাঁদের তত বেশি বেকার থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

এ বছরের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে বেকার ছিল ২৬ লাখ ৭৭ হাজার; যা আগের বছরের চেয়ে ৮৭ হাজার বেশি। ওই সময় কমপক্ষে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে সাড়ে ৪০ হাজার তরুণ-তরুণী বেকার ছিলেন। অথচ দেশে বিপুলসংখ্যক ভারতীয়, শ্রীলঙ্কান, চীনা ও অন্যান্য দেশের কর্মীরা চাকরি করছেন বলে জানা গেছে। কর্মসংস্থানের অভাব ও অন্যদিকে চাকরিতে বিদেশিদের সংখ্যা বৃদ্ধি—এই বৈপরীত্যের কারণ অনুসন্ধান ও তরুণদের আরও কর্মমুখী করে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এ বছর থেকেই ক্রাউন সিমেন্ট ও প্রথম আলোর উদ্যোগ শুরু হয়েছে তারুণ্যের জয়োৎসব নামে এক নতুন আয়োজন। বছরজুড়ে ১৬টি আঞ্চলিক জয়োৎসব, ১০টি ক্যারিয়ার কর্মশালা, দুটি তারুণ্যের বৈঠকের মাধ্যমে সেখানে চিহ্নিত করা হয়েছে আগামী দিনের করণীয়।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়া বাংলাদেশেও এসে পড়েছে। রাইড শেয়ারিংয়ের বিস্তার,ভার্চ্যুয়াল বিজনেসের স্বীকৃতির পাশাপাশি গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে রোবটের আগমন নানাভাবে আমাদের তরুণদের শঙ্কিত করেছে। কিন্তু বছর শেষে যখন জানা যায়, চট্টগ্রামের প্ল্যানেটার লিমিটেডের তৈরি রোবট দক্ষিণ কোরিয়ায় রপ্তানি হয়েছে ২০১৮ সালে, তখন বোঝা যায় আমাদের তারুণ্যের শক্তি অপরাজেয়। কিশোর-তারুণ্যের সবচেয়ে বড় বেদনার বিষয় তাদের নায়কের চলে যাওয়া। আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্মদিনে (১৪ মার্চ) এ জগতের মায়া কাটিয়েছেন শিশু-কিশোর-তরুণদের নায়ক বিশ্বের প্রথম সারির তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী স্যার স্টিফেন উইলিয়াম হকিং।

২০১৮ সালের সাফল্য, শিক্ষা ও অনমনীয়তা নিয়েই আগামী দিনের জয়-পতাকা ওড়ানোর লড়াইয়ে আমাদের কিশোর–তরুণদের সাফল্য অব্যাহত থাকুক।

মুনির হাসান গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক