চীন কেন আফ্রিকার পছন্দের অংশীদার

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে চীন-আফ্রিকা সহযোগিতা ফোরামের (ফোকাক) এক বৈঠকে আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারপারসন ও রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামে আফ্রিকায় চীনের সহায়তা এবং বিনিয়োগ কৌশলের ভূয়সী প্রশংসা করেন। কাগামে বলেন, চীন ও আফ্রিকার মধ্যে সহযোগিতা পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং উভয় অংশীদারের উপকারের জন্য এই সহযোগিতার সম্পর্ক। পল কাগামের মতো আফ্রিকার বেশির ভাগ সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান সম্ভবত এ রকমই মনে করেন।

যদিও আফ্রিকান নেতৃত্ব চীনকে একটি মূল্যবান অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করেছে, তারপরও অনেকে বেইজিংকে আফ্রিকার আগ্রাসনকারী হিসেবে দেখছে। তাঁদের মতে, চীন আফ্রিকা মহাদেশে উপনিবেশ স্থাপনের চেষ্টা করছে। আসলে বর্তমানে চীন-আফ্রিকার সম্পর্ক দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। প্রথমটি হচ্ছে চীনবিরোধী মনোভাব, মূলত পশ্চিমা দেশগুলো এই মনোভাব পোষণ করে। উদাহরণস্বরূপ সম্প্রতি ওয়াশিংটনে হেরিটেজ ফাউন্ডেশনে পররাষ্ট্রনীতি-সংক্রান্ত এক ব্রিফিংয়ে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন আফ্রিকায় চীনের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেন। তিনি দাবি করেন যে মহাদেশটি বেইজিংয়ের নতুন ঔপনিবেশিকতার শিকার হয়ে পড়ছে এবং এ জন্য আফ্রিকাকে ঋণের জালে বন্দী করার জন্য চীন নানা কৌশল গ্রহণ করছে। আফ্রিকা মহাদেশজুড়ে চীন ছোট-বড় মিলিয়ে হাজার হাজার প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে, যেগুলো আফ্রিকার অর্থনীতির চেহারাই বদলে দিচ্ছে। আফ্রিকার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে চীন এত বিশাল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করছে না। এর পেছনে তাদের বড় ধরনের স্বার্থ রয়েছে।

বোল্টন বলেন, চীনের এ ধরনের তৎপরতার উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ প্রকল্পসহ কৌশলগত উদ্যোগগুলোর সম্প্রসারণ ঘটানো। মোটকথা বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বিস্তারই হচ্ছে চীনের আসল লক্ষ্য। যুক্তরাষ্ট্রের মতো অন্য পশ্চিমা সরকারগুলোও যেমন যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স আফ্রিকায় চীনের বিনিয়োগ ও ঋণসহায়তাকে উদ্বেগের বিষয় হিসেবে দেখছে। তাদের মতে, দক্ষিণ সুদান ও সুদানের মতো তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর শান্তি নষ্ট করছে চীন। আর স্বৈরতন্ত্র আছে আফ্রিকার এমন দেশগুলোকে তারা সমর্থন করছে, যেমন গ্যাবন। এ ছাড়া পশ্চিমারা চীনকে একটি বাণিজ্যিক সুযোগভোগী এবং আফ্রিকান পরিবেশের বিশাল দূষণকারী হিসেবে মনে করে। চীন-আফ্রিকার সম্পর্ক নিয়ে দ্বিতীয় ধারণাটি হলো চীন হচ্ছে আফ্রিকার শুভাকাঙ্ক্ষী। চীন আফ্রিকায় যা করছে, তা আফ্রিকার মঙ্গলের জন্য। আফ্রিকার বেশির ভাগ নেতৃত্ব তাই মনে করে। তারা মনে করে চীন হচ্ছে তাদের রক্ষাকর্তা এবং বিশ্বাসযোগ্য মিত্র। তাদের দৃষ্টিতে চীন হচ্ছে তাদের অংশীদার, যারা কোনো স্বার্থ ছাড়াই তাদের সহায়তা দিচ্ছে। এ ছাড়া অন্য সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রকে সম্মান করার জন্য আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে চীন বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। আফ্রিকার অনেক রাষ্ট্রপ্রধান এ রকম মনে করেন। তাঁরা মনে করেন না যে চীন আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনের কোনো চেষ্টা করছে।

কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ আছে, যেগুলো চীনকে আফ্রিকার পছন্দের অংশীদারে পরিণত করেছে। আফ্রিকানদের কাছে চীনের চারটি বড় ধরনের আকর্ষণ আছে: এগুলো হচ্ছে শর্তহীন ঋণ প্রদান, দ্রুত সেবা ও সস্তায় পণ্য প্রদান, শান্তিরক্ষায় ভূমিকা পালন এবং বিকল্প উন্নয়ন মডেল। প্রথমে চীনের শর্তহীন ঋণ প্রদান আফ্রিকার সরকারগুলোকে বড় প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করতে সাহায্য করছে, অর্থের অভাবে যেগুলো এত দিন তারা করতে পারেনি। চীনের ঋণের কারণে আফ্রিকার অনেক সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চাপ এড়াতে সক্ষম হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, দ্রুততর পরিষেবা ও অবকাঠামোর জন্য জনগণের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য আফ্রিকান সরকারগুলোকে সহায়তা করেছে চীন। আফ্রিকার অনেক মানুষ এখন চীনা কোম্পানির পরিবহন ব্যবহার করছে, স্বাস্থ্য ও টেলিযোগাযোগ খাতে চীনের সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে।

তৃতীয়ত, চীন এখন আফ্রিকায় শান্তি ও নিরাপত্তার প্রকল্পগুলোতে নিযুক্ত। আটটি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে চীনের সেনারা অংশগ্রহণ করছে, যার পাঁচটি হচ্ছে আফ্রিকায়। তা ছাড়া চীন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দ্বিতীয় বৃহত্তম আর্থিক সহায়তা প্রদানকারী দেশ এবং তারা সোমালিয়ায় আফ্রিকান ইউনিয়ন মিশনে অর্থায়ন করছে।

চতুর্থত, চীনের দ্রুত ও সফল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ইতিহাসটি এমন একটি মডেল, যা আফ্রিকার অনেক দেশ তা অনুসরণ করতে পারে। নীতির সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে চীনের ক্ষমতা সম্পর্কে সবাই অবহিত এবং তা আফ্রিকান নেতাদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। বিশ্বব্যাংকের মতে, প্রায় ৪০ বছর ধরে চীন উন্নয়নের অপ্রচলিত পথের মাধ্যমে তার ৮০০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে সমর্থ হয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে এটি সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অনেকগুলো অর্জন করেছে। মোটকথা যে যা-ই বলুক না কেন, চীন আফ্রিকার দেশগুলোর হৃদয় জিতে নিয়েছে।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: রোকেয়া রহমান

ড. মেহারি তাদ্দেলে মারু আফ্রিকান ইউনিয়নের হাই অ্যাডভাইজরি গ্রুপের প্রধান সদস্য