নতুন মন্ত্রিসভা, নতুন চ্যালেঞ্জ

নতুন মন্ত্রিসভায় চমক থাকবে বলে ক্ষমতাসীন মহল থেকে আগেই জানানো হয়েছিল। কিন্তু চমকটা যে এত বড় হবে, তা সম্ভবত কেউ ভাবেননি। সরকারের যেকোনো কর্মসূচি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ প্রশাসনের পাশাপাশি একটি সুদক্ষ মন্ত্রিসভাও থাকা অপরিহার্য। এই প্রেক্ষাপটে একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল যে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন, আমরা তাকে স্বাগত জানাই।

মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই বেশ সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন। তাঁর প্রথম মন্ত্রিসভায় প্রবীণ ও নবীনের সমন্বয় ছিল, সেই সঙ্গে মন্ত্রিসভার আকারও তুলনামূলকভাবে ছোট ছিল। দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় তারুণ্যের আধিক্য থাকলেও পরবর্তী কালে প্রবীণদের অন্তর্ভুক্ত করে সমতা আনার চেষ্টা করেছেন। তৃতীয় মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে ১৪–দলীয় জোটের শরিক ও জাতীয় পার্টি থেকেও বেশ কয়েকজনকে মন্ত্রী করা হয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটে বিচার করলে এবারের মন্ত্রিসভা অনেক বেশি নতুননির্ভর, অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ। কেউ কেউ অবশ্য অভিজ্ঞতার ঘাটতির কথাও বলবেন।

সংসদীয় ব্যবস্থায় মন্ত্রিসভায় কে থাকবেন, কে থাকবেন না সেটি পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। কিন্তু তারপরও বলতে হবে, এর আগে কোনো নতুন সরকার গঠনের সময়ে আগের মন্ত্রিসভার এত বেশিসংখ্যক মন্ত্রী বাদ পড়েননি। প্রথম আলোর শিরোনাম অনুযায়ী, নতুন এলেন ৩১, বাদ গেলেন ৩৬।  পুরোনোদের মধ্যে যাঁরা থাকলেন, আর যাঁরা বাদ পড়লেন, তা কিসের ভিত্তিতে করা হলো, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দুর্নীতি বা সাফল্য-ব্যর্থতার নিরিখে পুরোনো মন্ত্রীদের কাউকে বাদ দেওয়া হয়নি। তাঁর এই বক্তব্য পুরোনোদের জন্য কিছুটা সান্ত্বনা হলেও সরকারের অবস্থান হিসেবে তা যথার্থ হতে পারে না। যত বড় পদই হোক, সাফল্যের জন্য পুরস্কার এবং ব্যর্থতার জন্য তিরস্কার বা শাস্তির ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। অন্যথায় প্রশাসন বা সরকার পরিচালনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়ে।

পুরোনো মন্ত্রিসভায় এমন কয়েকজন মন্ত্রী ছিলেন, যাঁরা বৃহত্তর জনগণের স্বার্থের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিলেন। আবার কারও কারও বিভিন্ন সংগঠনে সাংগঠনিক অবস্থানই ছিল মন্ত্রী পদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিভিন্ন মহল থেকে তাঁদের বাদ দেওয়ার দাবি উঠেছিল অনেক আগেই। শেষ পর্যন্ত যে তাঁদের বাদ দেওয়া গেছে, সেটি নিশ্চয়ই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু আবার নতুন মন্ত্রিসভায় এমন কয়েকজন আছেন, যাঁরা বিভিন্ন কারণে সমালোচিত এবং অতীতে কারও কারও ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী।

তবে নতুন মন্ত্রিসভার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা, সংসদকে সচল করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। সেই সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচিগুলোকে দ্রুত বাস্তবায়ন করা। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার অঙ্গীকার আছে। সেটি যাতে শুধু অতীতের মতো কথার কথা না থাকে, সে বিষয়েও সংশ্লিষ্টদের সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশিত। নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেওয়ার আগেই ঘোষণা করেছেন, অর্থ মন্ত্রণালয় যেভাবে এত দিন চলেছে, সেভাবে চলবে না। এর মাধ্যমে তিনি অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনারই ইঙ্গিত দিয়েছেন বলেই আমরা ধরে নিতে চাই। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে যাঁরা দায়িত্ব পেয়েছেন, কর্তব্য পালনে তাঁরাও একই পথ ধরবেন বলে আশা করি।

উন্নয়ন কোনোভাবেই গণতন্ত্র ও সুশাসনের বিকল্প নয়। বাংলাদেশের সত্যিকার উন্নয়ন করতে হলে সব ক্ষেত্রে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতেই হবে। শেখ হাসিনার চতুর্থ মন্ত্রিসভায় নতুনের যে বিপুল সমাহার ঘটেছে, তাকে কাজে লাগিয়ে সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জোরদার হবে—এই প্রত্যাশা দেশবাসীর।