জেতার জন্য এত কিছুর দরকার ছিল কি?

দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও গবেষকেরা জিজ্ঞাসা করেন, ‘নতুন’ সরকারের কাছে আমার প্রত্যাশা কী? কী জবাব দেব? কী প্রত্যাশার কথা জানাব? এটা ঠিক যে আমরা চাই না দেশের আগামী সরকারও নদী, পাহাড়, বন দখলকারী, সাম্প্রদায়িক শক্তি দ্বারা পরিচালিত হোক। আমরা চাই, আগামী সরকার ত্বকী, তনু, দীপন, নিলয়, সাগর-রুনিসহ আরও অনেক শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষের খুনিদের বিচার করবে। ক্রসফায়ারের নামে খুন, গুম, আর পথে-ঘাটে, ঘরে-বাইরে যৌন নিপীড়ন-ধর্ষণের অবাধ ধারা বন্ধ করবে। প্রতিবাদী কিশোর-তরুণদের দমন করতে হেলমেট আর হাতুড়ি বাহিনী জন্ম নেবে না। উন্নয়নের নামে প্রাণ–প্রকৃতিবিনাশী প্রকল্প হবে না, সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্প আর দেশবিনাশী রূপপুর প্রকল্প বন্ধ হবে। সরকার সাম্প্রদায়িকতা আর জাতিবিদ্বেষ দূর করায় সক্রিয় থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংকসহ সব প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিবাজ, অদক্ষ, তোষামোদিদের আড্ডাখানায় পরিণত হবে না। সাম্য, ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, তার নামে বৈষম্য, অবিচার ও গণতন্ত্র হরণের ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে না। এসব প্রত্যাশা কি এই ‘নতুন’ সরকারের কাছে রাখার কোনো উপায় আছে, যেখানে এই সব কটিতে এ সরকারেরই আগের পর্বে প্রধান ভূমিকা ছিল?

এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশে নির্বাচন নিয়ে একটা উচ্ছ্বাস তৈরি করা হয়েছিল। তবে নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকে সরকারের ভাবগতিক দেখে সবার মধ্যে এই ধারণা জোরদার হয়েছিল যে নির্বাচনের ফলাফল সরকারই নির্ধারণ করবে। তবে কী ফলাফল সরকার নির্ধারণ করতে চায়, তা নিয়ে বিভিন্ন মত ছিল। একটা সাধারণ ধারণা ছিল যে সরকার অন্তত ২০০ আসন দলের দখলে রাখতে চেষ্টা করবে। বাকি ১০০ আসন নিজেদের শরিক ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে গেলে তাদের আপত্তি থাকবে না। সরল মনে প্রশ্ন আসবে, এভাবে নির্বাচন হয় নাকি? এটা কী করে সম্ভব? প্রকৃতপক্ষে, এ রকম ফলাফল সম্ভব করার জন্য যে বহুদিন ধরেই খুবই গোছানো পরিকল্পনায় কাজ হয়েছে, তা ঠিকই বোঝা গেছে। বিজ্ঞাপনী সংস্থা বা পিআর এজেন্সিসহ দেশি-বিদেশি বহু প্রতিষ্ঠান এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ করেছে। এসব কাজের কয়েকটি দিক ছিল প্রধান: প্রথমত, সরকারের সাফল্য এবং বাংলাদেশের জন্য আওয়ামী লীগের অপরিহার্যতা প্রচারে যত পথ ও পদ্ধতি আছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার। দ্বিতীয়ত, সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকে একদিকে পচানো, অন্যদিকে তার নড়াচড়ার ক্ষমতা বন্ধ করা। একদিকে হামলা, মামলা ও আটক করা, অন্যদিকে নিজেদের প্রচার বেগবান করা। তৃতীয়ত, প্রচারের মাধ্যমগুলোকে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির মধ্যে রাখা। টিভি টক শো, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, ফেসবুক যাতে সরকারের পক্ষে থাকে তার জন্য আইনি–বেআইনি সব পথ গ্রহণ। ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ তার একটি। চতুর্থত, সব প্রতিষ্ঠানে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা। পঞ্চমত, সমর্থক গোষ্ঠী সম্প্রসারণের জন্য আর্থিক প্রণোদনাসহ নানা ব্যবস্থা গ্রহণ।

নির্বাচনী প্রচারকালে গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত আমরা একই দৃশ্য দেখেছি। সবার জন্য সমান সুযোগের কথা নির্বাচন কমিশন বলেছে, কিন্তু নেতা-কর্মী-ধর্ম-জাতি-লিঙ্গ-দল-মত-বয়সনির্বিশেষে নির্ভয়ে, নির্বিঘ্নে, উৎসবমুখর পরিবেশে একমাত্র সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষেই প্রচারণা চালানো সম্ভব ছিল। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে আমি আমার এলাকাতেও শুধু সরকারি দলের মিছিল ও পোস্টার দেখেছি। শুনেছি তাদের সুন্দর সুন্দর গান, ভুভুজেলার আওয়াজ আর বেতার-টিভিতে বিজ্ঞাপনী প্রচার। দেখেছি, শুনেছি সারা দেশে সরকারি দলের বাইরে বহু প্রার্থী এবং তাঁদের নির্বাচনী প্রচার আক্রান্ত হয়েছে, পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার করেছে, অসংখ্য মিথ্যা মামলা হয়েছে। সরকারি দলের প্রার্থীদের পক্ষে প্রশাসন ও পুলিশ সদা সক্রিয় ছিল, সর্বাত্মক সহযোগিতায় ছিল নির্বাচন কমিশন। এ রকম ভিডিও অনেক পাওয়া যাচ্ছে, আমিও একাধিক দেখেছি, যেখানে স্থানীয় পর্যায়ে সরকারদলীয় সমাবেশে বক্তারা সরাসরি কর্মসূচি ঘোষণা করছেন নৌকা ছাড়া অন্য সব প্রার্থী ঠেকানোর, হুমকি দিচ্ছেন নৌকা ছাড়া অন্য কোথাও ভোট দিলে ভয়াবহ পরিণতির। অবিরাম হামলা, মামলা, হুমকি আর নিয়ন্ত্রণ দিয়ে সরকারি দলে নিশ্চিন্ত অবস্থা, উৎসবমুখর পরিবেশ, আর তা ছাড়া বাকি সবার জন্য উৎসবের বদলে ভয়ের পরিস্থিতি এটাই ছিল নির্বাচনপূর্ব পরিস্থিতি।

বাংলাদেশের মানুষ সাধারণভাবে আড্ডা ও তর্কপ্রিয়, রাজনীতিমনস্ক এবং নিজের মতপ্রকাশে আগ্রহী। নির্বাচনের সময় তাই দেশজুড়ে বিশাল আড্ডা, তর্ক-বিতর্কের আবহাওয়া, চায়ের দোকান, ফার্মেসিসহ সর্বত্র জমজমাট আলোচনা আমাদের খুব পরিচিত দৃশ্য। এবারের নির্বাচনে এই দৃশ্য ছিল না। শুধু নৌকার পক্ষেই আসর বসেছে, তা–ও প্রতিপক্ষ না থাকায় সেগুলোও জমেনি। সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটল নির্বাচনের আগের রাত থেকে। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যাচ্ছে: কোনো কোনো কেন্দ্রে আগের রাতে বা ভোট গ্রহণের আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়েছে। অভিযোগ হলো, এর মধ্য দিয়ে ৩০ শতাংশ ভোট আগেই নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, পোলিং এজেন্ট, সমর্থক, ভোটারদের কেন্দ্রের আশপাশে আসার পথে বাধা দেওয়া হয়েছে। আক্রমণ, হুমকি, ধরপাকড়—সবকিছুই কাজে লাগানো হয়েছে। তৃতীয়ত, দিনের বেলা বিভিন্ন সময় সরকারি দলের কর্মীরা ব্যালট পেপারে সিল মেরে মেরে বাক্স ভরেছে। আমি দেখেছি, আমার ভোটকেন্দ্রে ভোটারের সংখ্যা সকাল থেকেই খুব কম ছিল, সারা দিনে ২০ শতাংশের বেশি হয়েছে বলে মনে হয় না। চারদিকে শুধু সরকারি দলের পোস্টার আর কর্মীরা। এলাকায় আশপাশের কেন্দ্রগুলোতে অবস্থা একই রকম দেখেছি। প্রার্থী ৮ থেকে ১০ জন হলেও কোথাও কোথাও পোলিং এজেন্ট একজন।

ফলাফল দেখে বোঝা গেল, সরকারের যে প্রস্তুতি ছিল, সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের সংগঠন, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্মিলিত আয়োজন যা ছিল, তাতে আগে পরিকল্পনা থাকলেও বিজয় ২০০ বা ২২০ আসনে গিয়ে থামতে পারেনি। সরকারি দলের পক্ষে ভোটসংখ্যাও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। উল্লিখিত সবার সম্মিলিত চেষ্টায়, উৎসাহে, পরিশ্রমে মোট ভোটের সংখ্যা এবং সরকারি দলে প্রাপ্ত ভোটের হার—দুটোই অস্বাভাবিক বেশি হয়েছে। এগুলো করতে গিয়ে কোনো কোনো কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো কোনো প্রার্থী অস্বাভাবিক কম এমনকি শূন্য ভোট পেয়েছেন।

নির্বাচনে বিজয়ের জন্য কি আওয়ামী লীগের এত কিছু দরকার ছিল? আগে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, প্রচারে যে একাধিপত্য তৈরি হয়েছিল, তাতে ভোটের দিন এসব কাণ্ড না করলেও আওয়ামী লীগ জিততে পারত। কিন্তু জনগণের মুখোমুখি হতে তারপরও ক্ষমতাসীন দল ভয় পেয়েছে। সে জন্যই এই ঘটনা ঘটল। রাষ্ট্রের সব শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের দমন করে এ রকম একতরফা নির্বাচন সরকারি দলের শক্তি প্রমাণ করে না; বরং এটাই প্রতিষ্ঠিত হয় যে নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাওয়া এই দল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। এ রকম একটি শক্তিশালী দল, যার উল্লেখযোগ্য জনসমর্থনও আছে, তার এই করুণ দশা হলো কেন, সেটাই এক বড় প্রশ্ন।

সন্দেহ নেই, ২০১৪ সালের পর এবারের নির্বাচন ক্ষমতাসীন দলের জন্য আরও খারাপ নজির হয়ে থাকল। তাতে অবশ্য সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের কিছু আসে–যাবে বলে মনে হয় না। কেননা, সরকারের কাছে, তার দেশি–বিদেশি সহযোগীদের কাছে ক্ষমতাই আসল। পথ ও পদ্ধতি বৈধ কি অবৈধ, নৈতিক কি অনৈতিক, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠান বিনাশে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জন্য ফলাফল কী, সেসব বিবেচনার গুরুত্ব খুব কম।

আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অথনীতি বিভাগের অধ্যাপক