দুর্নীতির রাশ টানতে হবে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে টানা তৃতীয়বার ক্ষমতা গ্রহণ করল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। অনেকেই আশা করছেন, এই সরকার কিছু মৌলিক পদক্ষেপ নেবে, বিশেষত দুর্নীতির বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলা হয়েছে।

দুর্নীতি যেন এই সমাজে নীতি হয়ে গেছে। একসময় সরকারি কার্যালয়ে কর্মকর্তারা লুকিয়ে দুর্নীতি করতেন। কিছু লজ্জা-শরমের ব্যাপার ছিল। কিন্তু এখন আর এসবের বালাই নেই। সবাই যেন দল বেঁধে দুর্নীতি করেন। বৈধ বা অবৈধ যে কাজেই মানুষ যাক না কেন, ‘খরচ’ দিতেই হবে। এমনকি পরিবার ও সমাজও দুর্নীতিবাজ মানুষকে খারাপ চোখে দেখে না। দুর্নীতিবাজ আত্মীয়ের দানখয়রাত বা আতিথেয়তা নিতেও সিংহভাগ মানুষের বাধোবাধো ঠেকে না। অন্যদিকে যে সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতি করেন না, তাঁরা সমাজে অপাঙ্‌ক্তেয়। কারণ, তাঁরা আত্মীয়-পরিজনদের জন্য অত খরচ করতে পারেন না, যা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা পারেন।

দুর্নীতি সব উন্নয়নশীল দেশেই কমবেশি দেখা যায়। ভারত ও চীনের মতো দেশেও ব্যাপক দুর্নীতির কথা শোনা যায়। চীনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে রীতিমতো জিহাদ ঘোষণা করতে হয়েছে। গত বছর তিনি যখন প্রেসিডেন্ট পুনর্নির্বাচিত হলেন, তখন তাঁর মূল
স্লোগানই ছিল দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। এ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির কয়েক হাজার কর্মীকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

চীনে যে ধাঁচের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, মার্কিন প্রবাসী চীনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিন ঝিন পির মতে, তা হলো ক্রোনি ক্যাপিটালিজম। বাংলা করলে এর অর্থ দাঁড়ায় স্বজনতোষী পুঁজিবাদ। এই ব্যবস্থার বিশেষত্ব হলো, এখানে রাষ্ট্রের কর্মচারী-দালাল-রাজনৈতিক নেতারা সব মিলেমিশে দুর্নীতি করেন। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এই দুর্নীতি হয়ে থাকে। সবাই যার কমবেশি ভাগ পেয়ে থাকেন। ব্যাপারটা হলো, আগে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঘুষ খাওয়ার যুগে অনেক ক্ষেত্রে ঘুষ ছাড়াও সরকারি কার্যালয়ে কাজ করানো যেত। কিন্তু এখন সেটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এখন এই সিন্ডিকেটের
দ্বারস্থ না হলে সাধারণ মানুষের পক্ষে কাজ করানো সম্ভব নয়। আগে যার কিছু সম্ভাবনা ছিল, এখন তা–ও নেই। দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বেড়ে যাওয়ার এটি অন্যতম কারণ। শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, এতে সাধারণ মানুষের ব্যয়ও বেড়ে গেছে।

মিন ঝিন পি বলেন, তত্ত্বগতভাবে ও বাস্তবে এ ধরনের যোগসাজশমূলক দুর্নীতি ব্যক্তিগত দুর্নীতি থেকে অধিকতর ধ্বংসাত্মক। কারণ, এতে রাষ্ট্রের সাংগঠনিক ও নিয়মতান্ত্রিক রূপটি ধ্বংস হয়ে যায়। একই সঙ্গে তা যেমন চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে যায়, তেমনি এতে ঘুষখোরদের প্রাপ্তিও অনেক বেশি। কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো, অনেক মানুষ মনে করে, সরকারি দপ্তরে কাজ করাতে গেলে অফিস খরচ দিতে হয়। ব্যাপারটা অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মানুষ যেন সরকারি দপ্তরে ঘুষ দিয়ে স্বস্তি বোধ করে। মূলত নিজের কাজটা ঠিকঠাক করিয়ে নেওয়ার জন্যই হয়তো তাঁরা এমনটা করেন। কিন্তু এই মনোভাব মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।

মিন ঝিন পি চায়না’স ক্রোনি ক্যাপিটালিজমবইটির ইন বেড উইথ দ্য মাফিয়া অধ্যায়ে বলেছেন, এই যে সংঘবদ্ধ অপরাধ, তার যেমন স্থানীয় সরকারের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব আছে, তেমনি সংগঠিত অপরাধী চক্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে যে যোগসাজশ—রাষ্ট্রের অখণ্ডতার ওপর তার প্রভাব আরও অনেক সুদূরপ্রসারী। দৃশ্যত এ ধরনের যোগসাজশের কারণে চীনা রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলাজনিত ও প্রশাসনিক সক্ষমতা ধ্বংস হচ্ছে। একদিকে সংগঠিত অপরাধের পরিসর বড় হচ্ছে, অন্যদিকে তারা সব পদস্থ কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিল করতে ইচ্ছুক। ফলে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোতে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের চক্র ক্রমেই বড় হচ্ছে। চীনের ক্ষমতা–দম্ভী রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের অধীনে গোপন পুলিশের কার্যক্রম চলে। এর বড় কর্তারা সংগঠিত অপরাধ চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন। অথবা তাঁরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ এসেছে। পৃথিবীতে কোনো কিছু তো কেউ এমনি এমনি দেয় না, তার একটা বিনিময় মূল্য থাকে। কর্মকর্তারা ঘুষ খেলে দাতাদের তো বিনিময়ে কিছু দিতে হয়।

অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ বলেন, স্বল্পমাত্রায় দুর্নীতি অনেক ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক হতে পারে, কিন্তু দুর্নীতি মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে তা আর প্রবৃদ্ধির সহায়ক থাকে না। কিন্তু এই মত কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না, কারণ যেকোনো মাত্রার দুর্নীতিই নৈতিক বিচারে অন্যায় এবং আইনি বিচারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অনৈতিক পন্থায় প্রবৃদ্ধি বা সমৃদ্ধি অর্জন কোনো ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়।

মুক্তবাজারব্যবস্থায় প্রতিযোগিতাই মুখ্য হওয়ার কথা। কিন্তু এই স্বজনতোষী ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা থাকে না। দেশে এমনিতেই ধনী-গরিবের ব্যবধান মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আর তার সঙ্গে যদি প্রতিযোগিতা বা সুযোগের সমতা না থাকে, তাহলে বৈষম্য অসহনীয় হয়ে ওঠে। যাদের উৎপাদনশীল সম্পদ নেই, পর্যাপ্ত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নেই, তাদের পক্ষে উন্মুক্ত বাজারের সুবিধা নেওয়া সম্ভব নয়। যে সমাজে কাজ পাওয়া নির্ভর করে জ্ঞানবান ও সম্পদশালীদের পৃষ্ঠপোষকতা ও ঘুষ দেওয়ার ক্ষমতার ওপর, সেখানে ব্যবস্থাটাই অত্যন্ত অমানবিক হয়ে যায়। প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও অর্থনৈতিক সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে যেখানে প্রতিযোগিতার বালাই নেই, সেখানে এমনটাই ঘটে। এই পরিস্থিতিতে যাঁরা পণ্য ও সেবা উৎপাদন করেন, তাঁদের একধরনের অনিশ্চিত ও অরক্ষিত পরিবেশে যুদ্ধ করতে হয়। আইন এখানে সুরক্ষা নয়, ঝুঁকির কারণ। এখানে আইনের আশ্রয় পাওয়া নির্ভর করে আপনি কে এবং এই আশ্রয় পাওয়ার জন্য আপনি কত টাকা খরচ করতে রাজি, তার ওপর।

কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আছে—মানুষের জন্য তা অত সমস্যা নয়, যদি সেই সরকার মানুষকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে পারে বা তার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারে। সেটা করতে গেলে অবশ্যই দুর্নীতির রাশ টেনে ধরতে হবে এবং মানুষকেও মনোভাব বদলাতে হবে। তবে সরকারকেই মূল ভূমিকা নিতে হবে। তাহলে জনসাধারণের সমর্থন পেতে অসুবিধা হবে না।

প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর সহ-সম্পাদক