পুঁজিবাদ যেভাবে আমাদের মেরে ফেলছে

বেশ কয়েক বছর আমি আর আমার এক বন্ধু ভেনেজুয়েলায় ছিলাম। সেখানে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চিরশত্রু বলে পরিচিত সাবেক প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের প্রতিষ্ঠিত স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিকগুলোতে আমার বিনা মূল্যে যে চিকিৎসাসেবা নিয়েছি, তা ভুলবার নয়। আমার দেশ আমেরিকায় আমি বিনা মূল্যে এমন উন্নত চিকিৎসাসেবা কল্পনাও করতে পারি না। এর কারণ হলো, পুঁজিবাদের ধ্বজাধারী আমেরিকা যুদ্ধ বাধানো এবং করপোরেট মুনাফা অর্জনের পেছনে এত বেশি সময় দেয় যে মৌলিক মানবাধিকার নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় সে পায় না। ভেনেজুয়েলার একটি ক্লিনিকের একজন নারী চিকিৎসক আমাকে বলছিলেন, বিশ্বের যেখানেই যুদ্ধ সেখানেই মার্কিন সেনাবাহিনীর দেখা পাওয়া যাবে। আর সেসব যুদ্ধবিধ্বস্ত জায়গায় কিউবার লোকও থাকে। তবে তারা সেনা নন, তাঁরা চিকিৎসক।

২০১৭ সালে জাতিসংঘের তীব্র দারিদ্র্য ও মানবাধিকার বিষয়ক স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার  একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, চীন, সৌদি আরব, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ভারত, ফ্রান্স ও জাপান সম্মিলিতভাবে জাতীয় নিরাপত্তা খাতে যত অর্থ ব্যয় করে, তার চেয়ে বেশি ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র। আর সেই যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী উন্নত বিশ্বের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। জাতিসংঘের স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার ওই সময় বিশদ তথ্য দিয়ে একটি প্রতিবেদন পেশ করেছিলেন। সেখানে তিনি আমেরিকার সমাজব্যবস্থাকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে অসম সমাজ’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, আমেরিকায় অন্তত চার কোটি মানুষ দরিদ্র। সেখানে মৃত্যুহার বাড়ছে এবং সামাজিক অস্থিরতা ও নেশার কবলে পড়ে বহু পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেছেন, এই সবকিছুর পেছনে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা একটি বড় ভূমিকা রাখছে।

আমেরিকান সমাজে এখন সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মাদক। এই সমাজের একটি বিরাট অংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। অর্থ আর মুনাফা অর্জনের সীমাহীন নেশা এখানকার মানুষের জীবনকে এতটাই অস্থির করে তুলছে যে বহু মানুষের পক্ষে আক্ষরিক অর্থেই এই সমাজ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর ২০১৮ সালের জরিপে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার এই অস্থির ও নির্বান্ধব জীবনকে মেনে নিতে না পারায় সমগ্র দেশের মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে।

সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নব্য উদার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষ অর্থের পেছনে ছুটতে ছুটতে ক্রমাগত একা হয়ে যাচ্ছে। পারস্পরিক বন্ধন ছুটে যাচ্ছে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এই নিষ্ঠুর নিঃসঙ্গতা মানুষের জীবনে হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। মানুষ ভোগবাদী জীবনের অস্থিরতার জন্য অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বিষণ্নতা থেকে আরোগ্যলাভের জন্য সেখানে ‘বিষমিশ্রিত’ বিশাল বিশাল ওষুধ কোম্পানি খোলা হচ্ছে। ওষুধ কোম্পানিগুলো কোটি কোটি ডলারের মুনাফা তুলে নিলেও দিন শেষে বিষণ্ন মানুষগুলোর জীবনে প্রাণখোলা হাসি–আনন্দ আসছে না।

মার্কিন পুঁজিবাদ শুধু যে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বা আশপাশের দেশের মানুষের পারিবারিক বা সামাজিক বন্ধনের জন্য হুমকি, তা নয়। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও ভোগবাদী সমাজ সম্প্রসারণের কারণে পণ্যের অতি ব্যবহার, অপব্যবহার ও বিষক্রিয়া বাড়ছে। এটি গোটা পৃথিবীকে এমন এক ধ্বংসের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, যেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব হবে না। ১৯৮৯ সালের আগে মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল সুইজি বলেছিলেন, অধিক ভোগ ও উৎপাদন প্রবণতার কারণে গ্রিনহাউস ইফেক্ট বা কার্বন নিঃসরণ ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়ছে। পুঁজিবাদ যত বেশি বিকশিত হবে, এই ধারা তত বাড়তে থাকবে। ক্রমেই পৃথিবী ধ্বংসের দিকে যেতে থাকবে।

 এক্সট্রিম সিটিজ: দ্য পেরিল অ্যান্ড প্রমিজ অব আরবান লাইফ ইন দ্য এজ অব ক্লাইমেট চেঞ্জ বইয়ের লেখক অ্যাশলে ডওসোন গত ডিসেম্বরে ভারসো বুকস ওয়েবসাইটে লেখা একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, কীভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ‘উগ্র পুঁজিবাদ’ এবং ‘পরিবেশবাদীদের বিক্ষোভকে অপরাধ সাব্যস্ত করার চেষ্টা’ দিয়ে গোটা বিশ্বকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। অ্যাশলে ডওসোন বলছেন, ট্রাম্প নিজেও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে আটকা পড়ে গেছেন। এ থেকে তিনি বের হতে পারবেন না। আমেরিকাও বের হতে পারবে না।

পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে এই ধনতান্ত্রিক অস্থির সমাজকে ভাঙতেই হবে। বিশ্বকে জাগতেই হবে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

বেলেন ফার্নান্দেজ মার্কিন লেখক ও গবেষক