বিজেপির আসাম-জুয়া

আসামজুড়ে মঙ্গলবার হরতাল পালনের সময়ের দৃশ্য।
আসামজুড়ে মঙ্গলবার হরতাল পালনের সময়ের দৃশ্য।

অসমজুড়ে ধর্মঘট
এগারো ঘণ্টার ‘বন্‌ধ্‌’-এ অসম আজ উত্তপ্ত। পুলিশের সঙ্গে অনেক জায়গায় সংঘাত হলো। জাতীয় মহাসড়ক অবরুদ্ধ। দিব্রুগড়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাওয়ের পাশাপাশি ভাঙচুর হলো বিজেপির কার্যালয়। মূলত নাগরিকত্ব আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী লোকসভায় উত্থাপনের বিরুদ্ধে অসমিয়া শিক্ষার্থীরা এই বন্‌ধ্ ডেকেছে। একই দাবিতে মিজোরামের আইজলেও আজ ব্যাপক বিক্ষোভের খবর মিলেছে।

প্রথমে নাগরিকপঞ্জি করে বিজেপি অসমে বাংলাভাষীদের সঙ্গে অসমিয়াদের সরাসরি বিরোধ বাড়িয়েছিল। এখন নাগরিক আইন সংশোধনের মাধ্যমে কেবল হিন্দু বে-নাগরিকদের সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে বিজেপি বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে চাইছে। কিন্তু অসমিয়ারা নিজেদের স্বার্থে বিজেপির এই রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে।

বিজেপি উত্থাপিত নাগরিকত্ব আইনে প্রস্তাবিত সংশোধন হলে কেবল হিন্দু উদ্বাস্তুদের ভারতজুড়ে নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ বাড়বে। মুসলমানদের বাদ দিয়ে কেবল হিন্দুদের জন্য নিয়ম শিথিল করতে চায় বিজেপি। এ নিয়ে অসমিয়াদের একাংশের সঙ্গে বিজেপির দূরত্ব তৈরি হলো। অসমিয়ারা ভাবছে, বিজেপি নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে হিন্দুদের সংখ্যা আরও বাড়াতে চায়। এটা তার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য।

বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা ভারত নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে বিজেপির এসব পদক্ষেপ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যম উদাসীন হলেও এর আঁচ থেকে বাংলাদেশ মুক্ত থাকবে না বলেই মনে হয়। বিজেপি খুব সচেতনভাবে, হিসাব-নিকাশ করেই এই খেলা খেলছে। খেলার মাঠটি অসমে হলেও বিজেপির মূল টার্গেট পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালিদের ভোট এবং বাংলাদেশকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে চাপে রাখা।

লোকসভা নির্বাচন সামনে রেখে ‘লাভ–ক্ষতি’র পরিসংখ্যান
লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গে আসন ৪২টি। আর আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত রাজ্য মিলে আসন ২৪টি। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির মাত্র দুজন লোকসভা সদস্য। আর সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতে আটজন। গত নির্বাচনের এই চিত্র সামনে রেখেই বিজেপি এখন অসমে রাজনৈতিক জুয়ায় লিপ্ত।

দলটির নীতিনির্ধারকেরা দেখেছেন, নাগরিকপঞ্জি এবং নাগরিক আইন সংশোধন উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গে তার আসন বাড়ার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, নাগরিক আইন সংশোধিত হলে বাংলাভাষী উদ্বাস্তু হিন্দুদের অনেকে লাভের সম্ভাবনা দেখতে পাবেন। অন্তত লাভের একটা বিভ্রম হলেও তৈরি হবে। এতে সেখানকার প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিএম ও তৃণমূলের ভোট কাটা পড়বে।

আবার নাগরিকপঞ্জি হওয়ায় অসমে মাওলানা বদরুদ্দীন আজমলের মুসলমানপ্রধান ‘গণতান্ত্রিক মোর্চা’র আসন কমার আশঙ্কা আছে। কারণ, নাগরিকত্ব আইন মুসলমান ভোটার কিছু কমাতে পারে সেখানে। অসমে গত এক দশকে এটাই ছিল বিজেপির মূল লক্ষ্য। আজমলের দল অনেকাংশে মুসলমান ভোটারনির্ভর। বিজেপি তাদের কিছুটা কোণঠাসা করতে পারল।

অন্যদিকে, নাগরিকত্ব আইনের ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতে স্থানীয় আদিবাসীরা খেপলেও সেখানকার অধিকাংশ রাজ্যে বিজেপির নতুন করে হারানোর কিছু নেই। মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরায় গতবার বিজেপি একটি আসনও পায়নি। এসব রাজ্যে তার আসন বাড়ানোর সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কারণ, এই পাঁচ রাজ্যে আসনই আছে আটটি!

অন্যদিকে, অসমে ‘অসম গণপরিষদ’ ক্ষমতাসীন বিজেপি জোট ছেড়ে গেলেও ক্ষমতাচ্যুত হচ্ছে না তারা। ক্ষমতায় থাকতে সেখানে বিধানসভায় আসন দরকার ৬৪টি। বিজেপির আছে ৬১টি এবং তার অপর মিত্র বোড়োদের একটি দলের আসন আছে ১৩টি। ফলে অসমে আপাতত কোনো বিপদ নেই। তবে লোকসভা নির্বাচন এলে এবং অসমিয়ারা তাকে ভোট না দিলে বিজেপি সেখানে বর্তমান ৭টি থেকে ৩-৪টি আসন হারাতে পারে। কিন্তু হিন্দুদের বাড়তি সমর্থনে নতুন কিছু আসন তারা পেতেও পারে। অসমের হিন্দুদের মাঝে কংগ্রেস মোটেই বিজেপির বিকল্প হতে পারছে না। উপরন্তু বিজেপি নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে অসমে যদি বাড়তি সংখ্যায় হিন্দুদের আকর্ষণ করতে পারে, তাহলে সেখানে বিজেপির সুদূরপ্রসারী লাভ রয়েছে বিপুল। এর মধ্য দিয়ে অসমের জনবিন্যাসে মুসলমানদের সংখ্যালঘুত্ব আরও বাড়বে। অসমিয়াদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও তাতে সংকুচিত হবে আরও।

একইভাবে নাগরিকপঞ্জি ও নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন নিয়ে বিজেপি পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতে একদিকে মুসলমানদের সংখ্যা কমাতে পারবে এবং বাড়তি সংখ্যায় হিন্দুদের পুনর্বাসন করতে পারবে বলে মনে করছে, যা তাকে কালে কালে অনেক সুবিধা দেবে। উত্তর-পূর্ব ভারতের অনেক রাজ্যে নাগরিকপঞ্জির প্রস্তাব ইতিমধ্যে বেশ আগ্রহ তৈরি করেছে। অন্তত মণিপুরে সেটা হবে বলেই মনে হয়।

মূল লড়াই পশ্চিমবঙ্গে?
আরএসএস-বিজেপি পরিবারের এই ‘জুয়া’ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দুরা যদি আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে প্রত্যাখ্যান করে বসে, তাহলে পুরো প্রকল্পটি সাময়িকভাবে মার খাবে। অসমে বাংলাভাষী হিন্দুদের দুর্দশা ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে খারাপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। বিজেপি নাগরিকত্ব আইনের প্রলোভন দেখিয়ে সেটা ভুলিয়ে দিতে চাইছে এখন। তবে এই রাজ্যে নাগরিকপঞ্জির প্রস্তাব ব্যাপক বিরোধিতার মুখে পড়েছে। কেউই অসমের মতো অরাজক পরিস্থিতি চাইছে না।

অন্যদিকে, মোদির দল নাগরিকত্ব আইন সংশোধন নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রচারণায় লিপ্ত হলেও লোকসভায় আদৌ তারা বিলটি পাস করাবে কি না, সে নিয়েও রয়েছে সন্দেহ। তবে আজ লোকসভায় বিলটি নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছে। অন্যদিকে, মোদির দল নাগরিকত্ব আইন সংশোধন নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রচারণায় লিপ্ত হলেও লোকসভায় আদৌ তারা বিলটি পাস করাবে কি না সে নিয়ে সন্দেহ ছিল গতকাল পর্যন্ত। তবে আজ শেষপর্যন্ত সংশোধন অনুমোদন করেছে লোকসভা।

লোকসভা নির্বাচনের ক্ষণ যত এগিয়ে আসছে, বিজেপি ততই নতুন নতুন রাজনৈতিক প্রকল্প নিয়ে হাজির হচ্ছে। অসমের নাগরিকপঞ্জি এবং এখনকার নাগরিকত্ব বিল সংশোধন উদ্যোগ থেকে অনুমান করা হচ্ছে, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকালে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে ব্যাপক রাজনীতি করতে চায় বিজেপি। ২০১৪ সালে যেটা করেছিল তারা অসমে।

নাগরিকত্ব বিলের প্রস্তাবিত সংশোধনের মূল ধারণাই গড়ে উঠেছে এই বিবেচনা থেকে যে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর প্রতিনিয়ত নির্যাতন চলছে এবং তা থেকে বাঁচতে তারা ভারত চলে যাচ্ছে। আর এই ‘নির্যাতিত হিন্দু’দের বাঁচাতে ও ঠাঁই দিতে ভারতে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন প্রয়োজন বলে মনে করে বিজেপি।

যদিও এরূপ বিবেচনা পুরোদস্তুর বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পক্ষে ভাবাবেগ তৈরির লক্ষ্যে দাঁড় করানো কিন্তু বাংলাদেশ সমসাময়িকভাবে কখনোই তার দেশ সম্পর্কে এরূপ প্রচারণার বিপক্ষে সজোরে কিছু বলেনি।

আলতাফ পারভেজ: ইতিহাস গবেষক