ইসিকে অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে

গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিস্ময়কর দিক হচ্ছে ২৮৮ আসন পেয়ে মহাজোটের নিরঙ্কুশ জয়। বাকি ১০টি আসনে (দুটির নির্বাচন স্থগিত) বিরোধী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট পেয়েছে ৭টি আসন। এর মধ্যে এই জোটের অংশীদার, একাধিকবার ক্ষমতায় থাকা ও বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপি মাত্র ৫টি আসন পেয়েছে। এই পাঁচজনের দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া আর কেউ তেমন পরিচিতও নন। নির্বাচন এবং নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। হয়তো আন্তর্জাতিক গবেষকেরা এই নির্বাচন নিয়ে গবেষণা করবেন। প্রশ্ন থাকবে, কেন একটি এত বড় দলের এত বড় বিপর্যয় এই একবিংশ শতাব্দীতে?

এই নির্বাচনে অনেক অভূতপূর্ব রেকর্ডও হয়েছে। অতীতে ১৯৭৩ ছাড়া, কোনো ক্ষমতাসীন দল বহুদলীয় নির্বাচনে এত আসন পায়নি। অপরদিকে মোট ১ হাজার ৮৫৫ জন বৈধ প্রার্থীর মধ্যে ১ হাজার ৪২২ প্রার্থী জামানতের টাকা হারিয়েছেন। কোনো এক আসনে একজন প্রার্থী একটি ভোটও পাননি। অনুসন্ধান করলে এমন বহু তথ্য পাওয়া যাবে, যা রেকর্ড হয়ে থাকবে। এই নির্বাচন নিয়ে আমি কোনো বিশ্লেষণে যাচ্ছি না। বিশ্লেষণ করার মতো তথ্য–উপাত্ত এখনো তেমন পাওয়া যায়নি। প্রায় সব নিবন্ধিত দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচিত সরকার এবং সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে যেটা যেমন বড় কথা, তেমনি ১৭ জনের প্রাণহানি এবং সুবর্ণচরের ঘটনা অতীব বেদনাদায়ক।

২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছিল। এবার এমন ঘটনা ঘটবে তা প্রত্যাশিত ছিল না। তবে অভিযুক্তদের অনেকে আটক হয়েছেন, এটা ভালো খবর। জানা যায়, ঘটনাটি ঘটে ভোটের রাতে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার ছিল কি না বা নির্বাচন কমিশন আদৌ আমলে নিয়েছে কি না, জানা যায়নি। নির্বাচনী প্রক্রিয়া ফলাফল গেজেট না হওয়া পর্যন্ত সমাপ্ত হয় না। কাজেই এ ক্ষেত্রে ৯১ ই–সহ আরপিওর ধারা প্রযোজ্য হয় কি না, দেখা যেতে পারত। অবশ্য সংজ্ঞামতে নির্বাচনী বিরোধ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনী সময় (Election Period) সমাপ্ত হয় না।

অপরদিকে রাজশাহীর প্রত্যন্ত গ্রামে বিরোধী দলকে ভোট দেওয়ায় গ্রামটিকে বিচ্ছিন্ন করা ও গ্রামবাসীর ওপর যে অপরাধে যা ঘটেছে তা তৃতীয় মেয়াদের নির্বাচিত সরকারের জন্য খুবই বিব্রতকর। অতীতে এমনটি দেখা যায়নি। অবশ্য সেখানেও প্রশাসন তৎপর হয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে। এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। কারণ, এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোর যোগফলই বড় ঘটনায় পরিণত হতে পারে।

‘অত্যন্ত সফল নির্বাচন’ হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশন ‘পিঠা উৎসব’ উদ্যাপন করেছে (বিভিন্ন পত্রপত্রিকার রিপোর্ট)। কিন্তু বিরোধী জোটের তরফে একদিকে যেমন নির্বাচন বাতিলের দাবি তোলা হয়েছে, তেমনি নির্বাচনে নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। তারা আইনের আশ্রয় নেবে কি না জানা নেই। তবে তাদের বক্তব্যে তেমনটাই ধারণা করা যায়। উল্লেখ্য, গেজেট প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে যেকোনো সংক্ষুব্ধ প্রার্থীকে আরপিও ও অন্যান্য আইন মোতাবেক আইনের আশ্রয় নিতে হবে।

২.
এই নির্বাচন নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে, যা প্রমাণসাপেক্ষ। অনেকেই যে ভোট দিতে পারেননি, তা সাধারণ মানুষের মুখেই শোনা। কেন্দ্রভিত্তিক পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে অনেক প্রশ্নই উঠে আসবে। নির্বাচন কমিশনের কাছে একটি অত্যন্ত বাস্তব প্রশ্ন তোলা যায়। প্রশ্নটি ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে। ফলাফল নিয়ে নয়, প্রশ্নটি প্রদত্ত ভোটের হার নিয়ে। অনেক বিশেষজ্ঞের কাছেই বিষয়টি বোধগম্য হয়নি। আমি ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে এবং মনে করি ইভিএম ব্যবহারই জাল ভোট ঠেকাতে পারে। তবে বুথ দখল, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো—এসব বিষয় অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। এবার ছয়টি সংসদীয় আসনে ব্যবহার করা ইভিএম উন্নত প্রযুক্তির এবং ভোটার চিহ্নিত করা ছাড়া ব্যালট ইউনিট উন্মুক্ত হয় না। বুথ দখল করে ভোটারদের নির্দিষ্ট জায়গায় ভোট দিতে বাধ্য করা ছাড়া একজনের ভোট অন্য কারও পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।

ছয়টি শহরে ইভিএম ব্যবহার হলেও শুধু ঢাকার দুটি আসনে ব্যবহৃত ইভিএমের ভোটের পরিসংখ্যানের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী আসনগুলোর ভোটের পরিসংখ্যানের তুলনামূলক বিচারে বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ভবিষ্যতে ইভিএম ব্যবহারকে সর্বজনীন করতে হলে এই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে হবে। ঢাকা–৬ ও ঢাকা–১৩—দুটি আসনে ইভিএমে ভোট পড়েছে যথাক্রমে ৪৫ দশমিক ৬ এবং ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ এই দুই আসনের চারপাশের সংসদীয় আসনে গড়পড়তা ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছে। ৬টি আসনে ইভিএমে গড় ভোট পড়েছে ৫১ দশমিক ৬৫ শতাংশ, অথচ নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে গড় ভোট পড়েছে ৮০ শতাংশ।

এই পরিসংখ্যান খুব স্বাভাবিকভাবেই ইভিএমের কার্যকারিতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। ইভিএমে প্রায় ৩০ শতাংশ ভোট কম হওয়ার কারণ কী হতে পারে? এসব আসন, বিশেষ করে ঢাকার আসনগুলো অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু ব্যাখ্যা প্রয়োজন। কারণ, ভবিষ্যতে সারা দেশে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে। এবং এ জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ইভিএম কেনা হচ্ছে। ইভিএম যদি তেমন কার্যকরই না হয়, তবে এত খরচ করে ইভিএমের প্রয়োজন কতখানি সেটাও ভাবার বিষয়। তা ছাড়া বুথ দখল হয়ে গেলে ইভিএম দিয়েও কোনো কাজ হবে না। নির্বাচন কমিশনকে এসব বিষয় অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।

৩.
আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ব্যালট ভরা হয়—এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। কিন্তু সে অভিযোগ এখনো চলছে। এবারের নির্বাচনেও এমন অভিযোগ ছিল ব্যাপক। এবং বিবিসির একটি ভিডিও বিশ্বব্যাপী ভাইরাল হয়। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স বা ট্রান্সলুসেন্ট ব্যালট বাক্স ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ব্যালট ধারণ করতে পারে। কাজেই একটি বুথে একটি ব্যালট বাক্স থাকার কথা। অতিরিক্ত ব্যালট বাক্স কেন্দ্রে আগাম দেওয়ার প্রয়োজন পড়ার কথা নয়। কাজেই রাতে বুথ দখল করে ব্যালট ভরতে হলে সেই বাক্সই ব্যবহার করতে হবে। এবং সকালে প্রার্থীদের এজেন্টদের তা দেখানোর কথা। কিন্তু সকাল থেকে প্রতিপক্ষের এজেন্ট না থাকলে ব্যালট বাক্সে কী আছে বা নেই, তা নিরীক্ষণ করার সুযোগ থাকে না। চ্যালেঞ্জ করার কেউ না থাকলে এক পক্ষ যা খুশি তাই করতে পারে। অবশ্য প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যোগসাজশ ছাড়া তা সম্ভব নয়।

এই নির্বাচনে এ ধরনের এন্তার অভিযোগ রয়েছে বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে। তবে বর্তমানে নির্বাচনী ব্যবস্থায় ভোটারদের স্বাক্ষরসহ সব তথ্যই ডিজিটালভাবে সংরক্ষিত রয়েছে। এর মাধ্যমে চাইলেই বেআইনি ভোট শনাক্ত করা সম্ভব। কারণ, আইন অনুযায়ী ব্যালট পেপারের মুড়িতে ভোটারদের সিরিয়াল নম্বর এবং দস্তখত থাকার কথা, যা প্রয়োজনে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিশ্চিত করা সহজ। ফলে এ ধরনের অভিযোগের সত্যতা নিরূপণ সম্ভব।

গেজেট প্রকাশের পর এখন একমাত্র আদালতই এসব অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে পারেন। তবে এ ধরনের অভিযোগ রোধ করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে অন্য উপায় ভাবতে হবে। বর্তমানে দেশের যোগাযোগব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রে সহজেই নির্বাচনসামগ্রী পৌঁছানো সম্ভব। এ কারণে আগের দিন রাতে নির্বাচনী সামগ্রী না পাঠিয়ে ভোট গ্রহণের দিন ভোরে পাঠানো যেতে পারে। অন্তত আগামী মার্চে উপজেলা নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন চিরাচরিত প্রথার বাইরে এ ব্যবস্থা পরীক্ষা করে দেখতে পারে। তবে বুথ দখল হলে সব ব্যবস্থাই বিপর্যস্ত হয়। বুথ দখল ঠেকানোই নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যতম দায়িত্ব। আমাদের দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় প্রতিনিয়ত কিছু কিছু পরিবর্তন আনা সম্ভব। এখানেই নির্বাচন কমিশনের আগাম প্রস্তুতির প্রয়োজন।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে এনএসইউর অনারারি ফেলো
[email protected]