চালের বাজার অস্থির কেন?

ধান-চালের বাজার আবার অস্থির। বাজারে গরিব মানুষের মোটা চালের কেজি এখন ৩৬ টাকা। আর চিকন চালের ভাত খেতে হলে সেই চাল প্রতি কেজি কিনতে হবে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়।

দেড় মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে ধান-চালের দর বাড়ছে। আর এক বছরের হিসাবে মোটা চালেরই দাম বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ।

হঠাৎ করে চালের দাম বাড়লেও কৃষকেরা লাভবান হচ্ছেন না। অথচ ক্রেতাদের চালের বাজেট বেড়ে গেছে। ভিত্তিবছর পরিবর্তন করায় দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে এক হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আর একই সময়ে সাধারণ মানুষকে চাল কিনতে বাড়তি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে।

চালের দরের এ ঊর্ধ্বগতির উত্তাপ থেকে নিম্নবিত্ত মানুষকে স্বস্তি দিতে খোলাবাজারে চাল বিক্রি কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। গত এক মাসেই সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের মাধ্যমে দুই লাখ ১৩ হাজার টন চাল বণ্টন করেছে। কিন্তু তাতেও দামের এ ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো যায়নি। সরকারের শেষ সময়ে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগও শুরু করা হয়নি।

হঠাৎ করে চালের দাম কেন বাড়ল? বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ড. মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর ধরে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে চালের দর স্বাভাবিক ছিল। এ বছর হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, কৃষকেরা ন্যায্যমূল্য না পেয়ে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন এবং সরকারি মজুতও কম।

দামের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে সরকারের বড় ভরসা সরকারি মজুত। তবে এ বছর মজুত পরিস্থিতিও খুব একটা ভালো নয় বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। গত বছর একই সময়ে মজুত ছিল ১৪ লাখ ৪০ হাজার ৫৬০ টন। আর এখন মজুত ১০ লাখ ৯৩ হাজার ৯১০ টন।

মজুত বাড়ানোর উদ্যোগও ধীরগতিতেই চলছে। ২ মে থেকে ধান-চাল সংগ্রহ শুরু হলে তখন প্রতি মণ ধানের দর ছিল ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা এবং চালের দর ছিল প্রতি কেজি ২৮ থেকে ৩০ টাকা। লক্ষ্য ছিল সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১০ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহ করবে খাদ্য বিভাগ। অথচ এখন পর্যন্ত মাত্র ছয় লাখ ৪২ হাজার টন ধান-চাল সংগ্রহ করতে পেরেছে খাদ্য বিভাগ। আর গত বছরের একই সময়ে সরকারের সংগ্রহ ছিল আট লাখ টনের বেশি। চালের দর বেড়ে যাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রার বাকি চাল সংগ্রহ করা যাবে কি না, তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।

খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক মনে করেন, সরকারের সংগ্রহ কম থাকায় দেশের মোট মজুতের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা হবে না। চালকল মালিকেরা যদি চুক্তি অনুযায়ী চাল না দেন তাহলে তাঁদের জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করা হবে। খাদ্যমন্ত্রী প্রথম আলোকে আরও বলেন, বিশ্ববাজারে গমের দাম কম আছে। সরকার প্রয়োজনে বিশ্ববাজার থেকে গম আমদানি করে চাহিদা মেটাবে।

অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, ধান-চালের দর হঠাৎ বেড়ে গেলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকেরা এ থেকে কোনো সুবিধা পাবেন না। কেননা, বেশির ভাগ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক মে ও জুন এ দুই মাসের মধ্যে তাঁদের কাছে থাকা ধান-চাল বিক্রি করে দেন। পরে ওই ধান চলে যায় ফড়িয়া ও চালকল মালিকদের কাছে।

এ বছর আমনের সময় বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ফলন না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে বড় চাষি ও ব্যবসায়ীরা তাঁদের গুদামে ধান-চাল ধরে রাখতে পারেন। অর্থনীতিবিদ মাহবুব হোসেনের মতে, এতেও চালের দাম বাড়তে পারে। এসব পরিস্থিতি মাথায় রেখে সরকারের উচিত দ্রুত দাম নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া।

ধানের উৎপাদন কমছে: গত বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন নিয়ে করা ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত বোরো মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭ শতাংশ কম এলাকায় ধানের উৎপাদন হয়েছে। সরকার আউশের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বিশেষ প্রণোদনা দিলেও এ বছর আউশে উৎপাদন না বেড়ে বরং গত বছরের তুলনায় এক লাখ ৭৩ হাজার টন কমেছে।

মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই দেশের খাদ্য পরিস্থিতি বেশ ভালো ছিল। ২০০৮-০৯ সালে ধান উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ২৪ শতাংশ আর উৎপাদন হয় তিন কোটি ১৩ লাখ ১৬ হাজার টন। পরের দুই বছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ২ দশমিক ১০ ও ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। কিন্তু ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কমে হয় ১ দশমিক ৪ শতাংশ। আর মোট উৎপাদন দাঁড়ায় তিন কোটি ৩৮ লাখ ৮৯ হাজার টন।

ধানের উৎপাদন কমার এ হার উদ্বেগজনক। অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, সরকারের ধান-চালের সংগ্রহ নীতির ব্যর্থতাতেই এমনটা ঘটছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), খাদ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এ বছরেই বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তার ওপর আলাদা তিনটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিটি গবেষণায় দেখা গেছে, এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত দেশে ধানের দর সবচেয়ে কম থাকে। ওই সময় কৃষকেরা বোরো কেটে হাট-বাজারে নিয়ে আসেন। কিন্তু তখন সরকারি সংগ্রহ পুরোদমে শুরু না হওয়ায় ধানের দাম থাকে কম।

গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুনের পর ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ধান কৃষকের হাত থেকে ফড়িয়া ও চালকল মালিকের হাতে চলে যায়। আর তখনই সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ গতি পায়। এতে ধানের দাম বেড়ে যায়। ফলে সরকারের সংগ্রহের পুরো সুফল যায় চালকল মালিক ও ফড়িয়াদের হাতে।

গত বছর চাল রপ্তানিসংক্রান্ত এক বৈঠকের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তৈরি এক কার্যপত্রে বলা হয়েছে, সরকারের সংগ্রহ কার্যক্রম দেরিতে শুরু হওয়ায় এ থেকে কৃষক কোনো লাভবান হচ্ছেন না। কয়েক বছর ধরে কৃষক প্রতি মণ ধান বিক্রি করে দেড় থেকে দুই শ টাকা লোকসান গুনছেন বলেও তাতে উল্লেখ করা হয়।