মজুরিকাঠামোর অসংগতিগুলো দূর করুন

দেশের তৈরি পোশাক খাতের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটলেও এই খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের শ্রী যে দিনে দিনে ম্লান হচ্ছে, তার প্রমাণ নতুন মজুরি বোর্ড। শ্রমিকেরা দাবি করেছিলেন, তাঁদের ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার টাকা করার। কিন্তু মজুরি বোর্ড আট হাজার টাকা নির্ধারণ করে, যা আপত্তি সত্ত্বেও শ্রমিকেরা মেনে নিয়েছিলেন এই আশায় যে এতে সৃষ্ট অসংগতিগুলো সংশোধন করা হবে।

কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে নতুন মজুরি বোর্ড ঘোষণার তিন মাস পার হলেও সরকার বা মালিকদের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিকারের উদ্যোগ না নেওয়ায় শ্রমিকেরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হন। অবশেষে একজন শ্রমিক নিহত ও বহু আহত হওয়ার পর সরকারের চৈতন্যোদয় ঘটে এবং গত মঙ্গলবার দুই মন্ত্রী মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন।

নতুন মজুরি বোর্ডের প্রধান অসংগতি হলো সপ্তম গ্রেডে শ্রমিকদের বেতন ২ হাজার ৭০০ টাকা বাড়লেও তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম গ্রেডে বেড়েছে মাত্র ৪৪ থেকে ৭৯ টাকা। অর্থাৎ অভিজ্ঞ শ্রমিকেরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ২০১৩ সালের মজুরি বোর্ড হয়েছিল তিন বছর পর। পূর্ববর্তী মজুরি বোর্ডের চেয়ে সে সময় শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির যে হার ছিল, পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালে ঘোষিত মজুরি বোর্ডে মজুরি বৃদ্ধির হার তার চেয়ে কম। ২০১৩ সালের মজুরি বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শ্রমিকদের মজুরি প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে। ফলে নতুন মজুরিকাঠামোয় কোনো শ্রমিকের মূল বেতন কমে গিয়েছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

শ্রমিকদের প্রধান আপত্তি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূল বেতন কমে গেছে। আর মূল বেতন কম হলে ওভার টাইম বা বর্ধিত কাজের মজুরি, উৎসব ভাতা ইত্যাদিও কমে যায়। গত কয়েক দিনে মজুরি নিয়ে ঢাকা, সাভার, গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে যে শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে, যাতে জানমালের ক্ষতির পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক মানুষ দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। মঙ্গলবার সাভারে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে সুমন মিয়া নামে একজন শ্রমিক নিহত হন। চিকিৎসকেরা প্রাথমিক তদন্তে তাঁর বুকে বুলেট ইনজুরি ছিল বলে জানান। এই ক্ষতি অপূরণীয়। গতকালও সাভারে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

নতুন বাণিজ্যমন্ত্রী ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী শ্রমিক-মালিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে আগামী এক মাসের মধ্যে মজুরি বোর্ডের অসংগতি ও ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করার কথা বলেছেন। এ ব্যাপারে তাঁরা মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটিও করে দিয়েছেন। আমরা আশা করব, দ্রুততম সময়ে কমিটি কাজটি শেষ করবে এবং তৈরি পোশাক খাতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনবে। কোনো দুর্ঘটনায় কারখানার শ্রমিক মারা গেলে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রেও সেই নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। অন্যদিকে আন্দোলনের কারণে যেন কোনো শ্রমিকের বিরুদ্ধে মালিকেরা ব্যবস্থা না নেন, সেই নিশ্চয়তাও দিতে হবে। অতীতে শ্রমিক আন্দোলনের কারণে শ্রমিকনেতাসহ বহু শ্রমিককে চাকরিচ্যুত ও হয়রানি করার অনেক উদাহরণ আছে। এবারও যেন তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেও শ্রমিকেরা সবচেয়ে কম মজুরি পান। এই শিল্পের মালিকদের বুঝতে হবে, শ্রমিকদের ঠকিয়ে কখনো শিল্পের বিকাশ সম্ভব নয়। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গত বছর তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ শতাংশ। শ্রমিকদের ঘাম-শ্রমে যেই শিল্পের উত্তরোত্তর বিকাশ ঘটে চলেছে, সেই শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা সরকার ও মালিকদেরই দায়িত্ব।