ইলিশের জীবনরহস্য

কবি বুদ্ধদেব বসু ইলিশকে এমনি এমনি ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’ বলেননি। তিনি দেখেছেন ‘রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে’ লোকালয়ে যাচ্ছে ‘রাশি রাশি ইলিশের শব’। অর্থমূল্যের বিবেচনা তো আছেই, তার চেয়ে বড় বিষয় হলো ঐতিহ্য। ইলিশ নিয়ে, বিশেষ করে পদ্মার ইলিশ নিয়ে বাঙালির গর্বের শেষ নেই। সেই গর্বের জায়গাটি বিস্তৃত করে দিয়েছিল ২০১৭ সালের একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

ওই বছর বাংলাদেশের ইলিশ মাছ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরপর এবার এই মাছের জীবনরহস্য উদ্‌ঘাটন নিয়ে বাংলাদেশের সাফল্যে আরেকটি পালক যুক্ত হলো। বাংলাদেশি গবেষক দল উদ্ভাবিত পদ্মার ইলিশের জিন-বিন্যাস বা জিনোম সিকোয়েন্স নিয়ে বিশ্বজুড়ে পরিচিত সাময়িকী বায়োমেড সেন্ট্রাল (বিএমসি) সম্প্রতি একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। লন্ডনভিত্তিক এই সাময়িকী বৈজ্ঞানিক গবেষণাসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে। ইলিশের জিনতত্ত্বের ওপর কাজ করা বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাংলাদেশের গবেষণাটি বিএমসিতে সবার আগে প্রকাশিত হওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে অনন্য গৌরবের বিষয়।

ইলিশ কীভাবে সমুদ্রের লোনা পানি ও স্বাদু পানি—দুই জায়গাতেই বসবাস করে, এই মাছের রোগবালাই কী, এটি কি বদ্ধ জলাশয়ে চাষযোগ্য, কেন ইলিশ এত সুস্বাদু, কেন একেক এলাকায় ইলিশের স্বাদ একেক রকম, পদ্মা নদীর ইলিশই–বা কেন বেশি সুস্বাদু—এসব প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। জিন-বিন্যাস উদ্‌ঘাটনের ফলে এখন এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়ার পথ তৈরি হলো। আর এসব জবাবের মধ্যে এই জলের উজ্জ্বল শস্য সফলভাবে আবাদ করার সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসিনা খানের নেতৃত্বে ইলিশের জীবনরহস্য উদ্‌ঘাটনের গবেষণায় যুক্ত ছিলেন কয়েকজন বিজ্ঞানী। তাঁদের কাছে দেশের মানুষ ঋণী হয়ে থাকল। জীবনরহস্য উদ্‌ঘাটনের ক্ষেত্রে এটি একটি মাইলফলক হয়ে থাকল। তাঁদের এই সাফল্য দৃষ্টান্ত হিসেবে নিয়ে অন্য ক্ষেত্রের গবেষকেরা উদ্দীপ্ত হবেন।

তবে ইলিশ নিয়ে গবেষণায় যত সাফল্যই আমরা পাই, ভুলে গেলে চলবে না, ইলিশের আঁতুড়ঘর হলো প্রধানত পদ্মা নদী। এই নদীর মতো বড় নদীগুলোকে ইলিশের প্রসব উপযোগী রাখা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। ডিম ছাড়ার মৌসুমে ইলিশ ধরা বন্ধের উদ্যোগ বরাবরই সব পক্ষ থেকে প্রশংসা পেয়েছে। বলপ্রয়োগ করে এ-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করার চেয়ে এ বিষয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলা বেশি দরকার।

সুখের কথা হলো বাংলাদেশ ও ভারত সরকার যৌথভাবে ইলিশ নিয়ে ভাবছে। ইলিশ পুনরুদ্ধারে ভারত সরকার ইতিমধ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তাতে বাংলাদেশ সর্বাত্মক সহায়তা দেবে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে অদূর ভবিষ্যতে ইলিশ সবার সাধ্যের মধ্যে পৌঁছাবে। এমন আশা করাই যায়।