আমরা রক্তের ভাইবোন

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম

প্রিয় আশরাফ ভাই,
মানুষ যখন জন্ম নেয়, মৃত্যু তখন তার ছায়াসঙ্গী হয়ে যায়। মৃত্যু তাকে আগলে রাখে, যত দিন না তার ডাক পড়ে অনন্ত আনন্দলোকে।

মানুষের চলে যাওয়াটা ভীষণ সত্যি, যেমন বিদায় জানানোটা খুব কষ্টের। তবে আপনাকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের গর্বের শেষ নেই। বিশাল জলরাশিতে খড়কুটো ধরে মানুষ যেমন বাঁচতে চায়, তেমনি আপনার মতো নীরবে থাকা ভালো মানুষকে অবলম্বন করে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চায় অগণিত মানুষ। আপনি মিশে থাকেন মানুষের অন্তর্নিহিত অদৃশ্য এক চাওয়ায়।

প্রিয় ভাই,
রক্তে ভেজা ছোটবেলার পর আপনার সঙ্গে ভালো করে কথা হয় যেদিন, তখন আপনি আম্মা (সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন) এবং সোহেলের সঙ্গে বসে কথা বলছিলেন, আমি অসম্ভব আনন্দ নিয়ে শুনছিলাম আপনার কথা। প্রখর বোধশক্তি, বুদ্ধিদীপ্ত সরস কথাবার্তা আপনার। খুব মজার ছিল আপনার প্রকাশভঙ্গি। আমি একপর্যায়ে বলেই ফেলেছিলাম, আব্বুকে (তাজউদ্দীন আহমদ) তো আমার তেমন দেখার সুযোগ হয়নি, তারপরও সামান্য যতটুকু দেখেছি এবং তঁার বন্ধু, চেনাজানা মানুষের কাছে তাঁর কথা যা শুনি, তাতে মনে হচ্ছে আপনি যেন কথা বলেন অনেকটা তাঁর মতো। গল্পচ্ছলে, উদাহরণ দিয়ে দিয়ে। আব্বুদের সময়ের মানুষ আপনি। আমার কথা শুনে আপনি খানিকটা লজ্জাই পেয়েছিলেন।

সোহেলকে আপনি বড় ভাইয়ের স্নেহে বিশেষ একটি স্থান দিয়েছিলেন। আপনাদের দুজনের বোঝাপড়া এবং মানসিক বন্ধন ছিল চমত্কার। কত দ্রুত সবকিছু স্মৃতি হয়ে যায়!

প্রিয় ভাই,
একটি প্রবাদ আছে, ‘তুমি যখন তোমার জন্য কিছু একটা পরিকল্পনা করে রেখেছ, সৃষ্টিকর্তা তখন মুচকি হেসে তোমার জন্য তাঁর পরিকল্পনা করে রেখেছেন।’ ২০১২ সালের ঈদুল ফিতর ছিল ২০ আগস্ট। ২২ তারিখ সকালে আমার ঢাকার বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা স্থির করে রাখা। ২১ তারিখ রাত আটটার দিকে কলবেলের শব্দ শুনে দরজা খুলতে গিয়ে হঠাৎ পায়ের স্যান্ডেল উল্টে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে গেল। পরদিন যাওয়া হলো না। হাতে প্লাস্টার। প্রচণ্ড ব্যথা।

এর চার দিন পর আমাদের প্রিয় বোন (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা, জননেত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা), অসাধারণ যঁার চিন্তাশক্তি, কর্মে যিনি অতুলনীয়, সেই বটবৃক্ষ আপা রেহানা আপাকে সঙ্গে নিয়ে আম্মার কাছে বাসায় এলেন। তাজউদ্দীন আহমদের জন্মস্থানের শূন্যতা পূরণ হলো।

নিয়ম অনুযায়ী ধানমন্ডি ৩/এ সড়কের কার্যালয় থেকে দলীয় মনোনয়ন ফরম নিতে গিয়ে দেখি, সেখানে আমার পক্ষ থেকে টাকা জমা হয়ে গিয়েছে। সেই সময় আমাদের দলের উপদপ্তরবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন মৃণালদা (মৃণাল কান্তি দাস, সাংসদ)। আমি তাঁকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, আশরাফ ভাই টাকা দিয়ে দিয়েছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে পাশের রুম থেকে আপনি বের হয়ে এসেছিলেন। আমার লজ্জিত চেহারা দেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা রক্তের ভাইবোন।’ আরও দু–চারটি কথা।

তারপর থেকে কখনো মনে হয়নি একা। খুব বেশি দেখা–সাক্ষাৎ না হলেও আপনার প্রচ্ছন্ন ছায়া ছিল। দেখা হলে, ফোনে কথা হলে সোহেলের কুশল জানতে চাওয়া ছিল আপনার অবধারিত। ছোট ছোট বাক্যের আপনার সেই কথাগুলো, আজ সব স্মৃতি।

প্রিয় ভাই,

মন ও কলম আর এক করতে পারছি না। আপনার জন্য কম বললেই বুঝি অনেক বলা হয়। আমার প্রিয় একটি উদ্ধৃতি আপনার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে উদ্ধৃত করছি, যা আজ শুধু আপনার সঙ্গেই যায়।

‘কাজ কারও আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে, প্রশংসা বা বাহবা শোনার জন্য নয়। জীবনযাপন কাউকে খুশি করা বা প্রভাবিত করে সুবিধা পাওয়ার আশায় নয়। জীবনযাপনে নিজেকে প্রকাশ করো উদার চিত্তে। তোমার উপস্থিতি বোঝানোর জন্য সংগ্রাম কোরো না, বরং এমনভাবে বাঁচো, যেন তুমি না থাকলে তোমার অনুপস্থিতির যে শূন্যতা, তা মানুষ বুঝতে পারে।’

সিমিন হোসেন রিমি সাংসদ, লেখক, সমাজকর্মী