প্রতিরোধে প্রকৃত ভারত

ধর্মঘটে ভারত অচল হয়ে পড়েছিল
ধর্মঘটে ভারত অচল হয়ে পড়েছিল

শুরু হওয়ার কথা ছিল ভোর ছয়টায়। শুরু হয়ে যায় তার আগেই। সোমবার রাত ১২টায়। খাদানে, বন্দরে। বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মঘট। ৪৮ ঘণ্টা। কুড়ি কোটির ওপর শ্রমজীবী মানুষ রাস্তায়। বিকল্পের সন্ধানে। দিনবদলের দিনলিপি। ব্যাহত স্বাভাবিক জীবন। স্তব্ধ দেশ। টলে গিয়েছে ভারত। বেয়নেটের মুখে বেনজির স্বতঃস্ফূর্ততা। রাজস্থানে পুলিশের নির্বিচারে গুলি-লাঠির মুখেও অনড়। জখম পঞ্চাশ, আশঙ্কাজনক বাইশ। রক্তাক্ত আলোয়ার তবু জমি ছাড়েনি। পশ্চিমবঙ্গে, বিজেপির বিরুদ্ধে ডাকা এই বন্‌ধ্ ব্যর্থ করতে নামে তৃণমূল। সঙ্গে সমস্ত শক্তি নিয়ে রাজ্য সরকার। কার বিরুদ্ধে ধর্মঘট, বোঝা দায়। যদিও পারেনি। ধর্মঘটিরা ছিলেন অকুতোভয়। একরোখা। ফতোয়া উড়িয়ে অচল মেহনতির বাংলা। মাটি কামড়েই আটচল্লিশ ঘণ্টা রাস্তায়। গ্রেপ্তারির শেষে জামিন নিয়ে আবার মিছিলে। অবরোধে।

কলকাতা একাত্তর নয়। কলকাতা উনিশ। যেন অঘোষিত জরুরি অবস্থা। মিছিল করার পর্যন্ত অনুমতি নেই। গ্রেপ্তার। তবু মিছিল। সত্তর দশকের পর গত ৪০ বছরে এ রকম আক্রমণের মুখে মেলেনি এমন সাড়া। অভূতপূর্ব। বাস, ট্যাক্সি উধাও। এমনকি ওলা, উবার পর্যন্ত। অ্যাপের আঙিনায় গলির দোকান সুইগি, জোম্যাটো পর্যন্ত বেপাত্তা। বন্ধ ব্যাংক। বন্ধ বিমা, সরকারি দপ্তর। বন্ধ এটিএমের ঝাঁপ। বন্ধ শিল্পাঞ্চল। স্কুল-কলেজ। নবান্নের চৌদ্দতলা থেকে মুখ্যমন্ত্রী দেখেছেন স্তব্ধ জনজীবন। রাজ্যবাসীর হিম্মত। পুবের জানালায় হাওড়া স্টেশন। ইতিহাস জানে দেড় শ বছর আগে এই স্টেশনেই ভারতের প্রথম শিল্প ধর্মঘট। মার্চ, ১৮৬২।

ভ্লাদিমির লেনিন তখনো ‘অন স্ট্রাইক’ লেখেননি। লিখবেন কী? লেনিনের তখন জন্মই হয়নি। আমেরিকার হে মার্কেটে শ্রমিকদের লড়াইয়েরও দুই দশক আগে নির্দিষ্ট সময়ের মেয়াদে মজুরির দাবিতে এই স্টেশনে ১২০০ মুটিয়া-মজুরের ধর্মঘট। ভারতে শ্রমিক জাগরণের প্রথম অস্ফুট সূচনা। শ্রেণি আন্দোলনের সেই শতাব্দীপ্রাচীন পরম্পরার উত্তরাধিকার। শ্রেণিযুদ্ধে পাল্টা জবাব। ঘুরে দাঁড়ানোর স্পর্ধিত বার্তা। হুমকিকে হারিয়ে প্রায় হরতালের চেহারা। রাজপথে সুকান্তের কবিতা, ‘নয়া ইতিহাস লিখেছে ধর্মঘট, রক্তে রক্তে আঁকা প্রচ্ছদপট।’

আসমুদ্র হিমাচল দেখেছে মেহনতির সার্বিক ঐক্য। এসমা, পুলিশের দমনপীড়ন উড়িয়ে চোয়ালচাপা লড়াই। দেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে নতুন পাতা। রাষ্ট্রের উপেক্ষা-অবহেলা, প্ররোচনা-প্রতারণা, নিও লিবারেল রাজ্য সরকারের চোখরাঙানি-ফতোয়ার কড়া জবাব। উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ, বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে দেশজোড়া সাধারণ ধর্মঘট এই প্রথম নয়। ১৮তম।

 ২৯ নভেম্বর, ১৯৯১। মনমোহন সিং তখন অর্থমন্ত্রী। সেই শুরু। তারপর থেকে তুমুল নীতি বদলের লড়াই। স্পনসরিং কমিটি অব ট্রেড ইউনিয়নসের ডাকে দেশ দেখেছে ১২টি সাধারণ ধর্মঘট। শ্রেণি আন্দোলনের এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়াতে প্রসারিত হয়েছে শ্রেণিসংগ্রামের পরিধি। উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ, বিশ্বায়নে আক্রান্ত সাধারণ শ্রমিকের ব্যাপক অসন্তোষ থেকেই প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় বেড়েছে যৌথ আন্দোলনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা আগ্রহ আকুতি।

যৌথ আন্দোলন আগেও হয়েছে। তবে শিল্পভিত্তিক। সিআইটিইউ থেকে আইএনটিইউসি, এইচএমএস থেকে এআইটিইউসি—বহু ক্ষেত্রেই হয়েছে একসঙ্গে আন্দোলন। ব্যাংক, বিমা, প্রতিরক্ষা, টেলিকম, কয়লা, রুগ্‌ণ শিল্পের মতো বহু ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে সার্বিক ঐক্য। ২০১০, ত্রয়োদশ সাধারণ ধর্মঘট। স্বাধীনতার পর সেই প্রথম, দেশজোড়া সাধারণ ধর্মঘটে আইএনটিইউসি। ২০১২, এক নতুন ইতিহাস। শ্রেণি আন্দোলনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়াতে শ্রেণিসংগ্রামের পরিধি আরও প্রসারিত। আরও বিস্তৃত শ্রেণিসংগ্রামের ক্যানভাস। সংগ্রাম-ঐক্য-সংগ্রামের সেই রাস্তা ধরে সেবার বিএমএস-ও। স্বাধীনতার পর প্রথম, সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এক মঞ্চে। একই দশ দফা দাবি নিয়ে দেশজোড়া ধর্মঘটে। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের এক নতুন পর্যায়ে।

গতবারেও গোড়া থেকে ছিল বিএমএস। শেষে সরে যায় আরএসএসের চাপে। কিন্তু তৃণমূলে ঐক্য হওয়াতে সংগঠনের কর্মীরা ছিলেন ধর্মঘটে। মাথা সরে গেলেও শরীর ছিল ধর্মঘটে। যেমন দিল্লিতে, তেমনই রাজস্থান বা মধ্যপ্রদেশের মতো বিজেপিশাসিত রাজ্যে। এ কারণে কেন্দ্রীয় স্তরে ঐক্যই যথেষ্ট নয়। জরুরি হলো সমস্ত শ্রেণির ঐক্য। ঐক্যবদ্ধ চিন্তা। উদারনীতির বিরুদ্ধে ২০১৬–এর ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৭টি সাধারণ ধর্মঘট সংগঠিত হয়েছে। এবারে আটচল্লিশ ঘণ্টা। ১৮তম ধর্মঘট।

রক্তশূন্য গ্রামীণ অর্থনীতি। বাড়ছে চাষের খরচ। কমছে ফসলের দাম। বাড়ছে অভাবী বিক্রি। অর্ধেক কৃষক ঋণের ভারে ন্যুব্জ। কৃষক তাই শহরমুখী। শহরে কাজ নেই। বাড়ছে শ্রমের মজুত বাহিনী। বাইরে সস্তা শ্রমিকের ভিড়। তুমি যদি কাজ না করো, অন্য অনেকে অপেক্ষায়। কমছে ট্রেড ইউনিয়নের দর-কষাকষির ক্ষমতা। ধর্মঘটের দিনই ইউনিয়নের অধিকার কেড়ে নিতে বিল লোকসভায়। বামপন্থী সাংসদদের ওয়াকআউট।

প্রতিবাদে কথা বলেছে রাস্তা। লাগাতার। রাজপথ থেকে আলপথ। শহর, শিল্পাঞ্চলের সঙ্গেই ছিল গ্রাম বন্ধ। অচল গ্রাম-ভারত। শ্রমিক-কর্মচারীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কৃষক-খেতমজুর। সমাজের সব অংশের মানুষের থেকে অফুরন্ত সমর্থন-সংহতি। বাড়ছে অসাম্য। একুশ শতকের ভারতে অসাম্য ছাপিয়ে গিয়েছে ব্রিটিশরাজকে। ব্রিটিশরাজ থেকে এখন বিলিওনেয়ার-রাজ।

মনমোহন সিংয়ের সময় ১ শতাংশের হাতে ছিল দেশের ৪৯ শতাংশ সম্পদ। এখন বেড়ে ১ শতাংশের হাতে ৭৩ শতাংশ সম্পদ। মে ২০১৪ থেকে মে ২০১৮। বিজেপি সরকারের চার বছর। দেশের শীর্ষ দশজন ধনকুবেরের সম্পদ বেড়েছে ৫,৬০০ কোটি ডলার। ৮,৪০০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ১৪,০০০ কোটি ডলার। এই দশে আছেন আদানি, আম্বানিরা। মোদির চার বছরে আদানির সম্পদ বেড়েছে ২৫০ শতাংশ। আম্বানির ১১৫ শতাংশ। অন্যদিকে, বিশ্ব ক্ষুধার সূচকে ১১৯ দেশের মধ্যে ভারতের স্থান পিছিয়ে এখন ১০০। গত বছরের থেকেও নেমেছে তিন ধাপ। মোদির ভারতে বিশ্ব ক্ষুধার সূচকে ভারত নেমেছে ৪৫ ধাপ।

মানুষ জবাব চান। মানুষ উত্তরের খোঁজে। মানুষ চান বিকল্প। চান বিকল্প নীতি। কৃষক চান ফসলের দেড় গুণ দাম। গরিব কৃষক, খেতমজুরের ঋণ মওকুফ। ভূমিহীনদের জন্য জমি। শ্রমিকেরা চান দিনে ৬০০ টাকা, মাসে ১৮,০০০ টাকা মজুরি। সব গ্রামে, সব শহরে রোগা। সবার জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষার নিশ্চয়তা। কৃষি, কৃষক এখন অ্যাজেন্ডা। আলোচনার কেন্দ্রে। মধ্যপ্রদেশের মন্দাসৌরে গুলিতে নিহত হওয়ার পরেও নড়তে সময় লেগেছে করপোরেট সংবাদমাধ্যমের। মহারাষ্ট্রে লংমার্চ। নাসিকে শুরু। ছিল ২৫,০০০। সাত দিন। ২০০ কিলোমিটার পথ। মুম্বাইয়ে এসে ৫০,০০০। শেষে টনক নড়ে
করপোরেট মিডিয়ার। মুখ ফিরিয়ে থাকা মিডিয়া বাধ্য হয় এই যন্ত্রণাবিদ্ধ বেনজির পদযাত্রার খবর-ছবি ছাপতে। তারপর রাজনৈতিক ধাক্কা। যাঁরা মোদির
ওপর আস্থা রেখেছিলেন, তাঁরা এখন রাস্তায়। গোরখপুরে বিজেপির হারে ছিল আবছা আভাস। উপেক্ষিত কৃষকের মনে জমে থাকা ক্রোধের প্রতিফলন শেষে তিন রাজ্যের বিধানসভার ভোটে। পালাবদলের স্পষ্ট ইঙ্গিত। ভেঙে পড়েছে সযত্ন লালিত নির্মাণ ‘অপ্রতিরোধ্য মোদি–এর অতিকথন। হিন্দিবলয়ে গো-হারা।

নয়া উদারবাদ এসে দাঁড়িয়েছে এক কানাগলির মুখে। এই সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কানাগলির মুখে রাস্তা দেখাতে পারে একমাত্র বামপন্থীরাই, কারণ এই নয়া উদার পুঁজিবাদকে ছাপিয়ে যাওয়ার অ্যাজেন্ডা শুধু তারাই দিতে পারে। যে কারণে অন্ধকার নয়, এই সংকট বামপন্থীদের জন্য তৈরি করেছে সম্ভাবনা।

ধর্মঘটের স্লোগানে, ব্যানারে পাকিস্তানের কিংবদন্তি কবি ফৈয়জ আহমেদ ফৈয়জে।

 ‘হাম মেহনত কাশ জাগ ওয়ালোন সে যব আপনা হিসসা মাঙ্গেগে, এক দেশ নাহি, এক খেত নাহি, হাম সারি দুনিয়া মাঙ্গেগে।’ যখন আমরা, এই দুনিয়ার মজদুররা আমাদের ন্যায্য অংশের দাবি জানাই, তখন কোনো এক টুকরো জমি যথেষ্ট নয়, আমরা দাবি জানাই গোটা দুনিয়ার সবকিছু। ‘ইয়ে ঘিরতে কালে বাদল আউর ইয়ে লাল সমুন্দর, মোদি সরকারকে লিয়ে চুনৌতি হ্যায়।’ এই ছিল আটচল্লিশ ঘণ্টার মেজাজ। মোদি সরকারকে চুনৌতি। চ্যালেঞ্জ, সরাসরি হুঁশিয়ারি। বদলাতে হবে নীতি। ‘নীতি বদলো, ওরনা বদলে দেঙ্গে সরকার।’ এই ধর্মঘটে মেক্সিকোর প্রবাদের অনুরণন: ‘ওরা আমাদের কবর দিতে চেয়েছিল, ওরা জানত না আমরা ছিলাম রক্তবীজ।’

আটচল্লিশ ঘণ্টার ধর্মঘট। মজদুর কিষানের প্রতিরোধের এক নতুন পর্যায়। ঐতিহাসিক এই ধর্মঘটের প্রভাব অবধারিতভাবে পড়বে দেশের রাজনীতিতে। মজদুর, কৃষক খেতমজুর—এই মেহনতি শ্রেণির যোগফলই জনসংখ্যার চার ভাগের তিন ভাগ। দুদিনের ধর্মঘট দেখিয়েছে ঐক্যের এক অনন্য নজির। বার্তা দিয়েছে এক নতুন অভিমুখের। মজদুর কিষান মৈত্রীই বিকল্প। হরিয়ানার আখচাষির গলায় প্রত্যয়, ‘দৌলত কী আন্ধেরি রাত মে মেহনত কা সুরজ ছুপা লিয়া, দৌলত কী আন্ধেরি রাত সে হাম আপনে সাবেরা মাঙ্গেগে।’

এই ধর্মঘটে ছিল কেন্দ্রের বিরুদ্ধে স্পষ্ট হুঁশিয়ারি: শ্রমজীবী মানুষ, মেহনতি জনগণ কিছুতেই তাদের মৌলিক অধিকারের ওপর আক্রমণকে মেনে নেবেন না। দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে করপোরেট স্বার্থ পূরণকে কিছুতেই যে তারা বরদাস্ত করবেন না, এই ধর্মঘটে ছিল তার জোরালো বার্তা। এই ধর্মঘটে ছিল সংঘ, বিজেপি’এর বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে দৃপ্ত বার্তা। শ্রেণি আন্দোলনেই শ্রেণি ঐক্য। এই ধর্মঘট ব্রেক অব সার্ভিসের হুমকির মুখে অকুতোভয়। এই ধর্মঘট ব্রেক অব পলিসির লড়াই।

এই ধর্মঘট ব্রেক অব গভর্নমেন্টের স্পর্ধিত হুঁশিয়ারি।

শান্তনু দে ভারতীয় সাংবাদিক