কালীগঙ্গা নদীতে সেতু

সেতুর সঙ্গে ‘বন্ধন’ শব্দটির যোগ অনিবার্য। এই যোগ আরোপিত নয়। এই যোগ স্বতঃস্ফূর্ত। নদীর দুই পাড়কে দৃঢ় বন্ধনে আটকে রাখে সেতু। একাধিক জনপদ তখন একাত্ম হয়। ‘সেতুবন্ধ’ কথাটির যথার্থতা তখন দৃশ্যমান হয়। ‘এপার’ চাইলেই যখন-তখন ‘ওপারে’ যেতে পারে। ‘ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস’—এই কথা তখন ‘এপারের’ পক্ষে বলা শক্ত হয়ে ওঠে। এপারের মানুষ ওপারে, ওপারের মানুষ এপারে যখন-তখন আসার সুযোগ তৈরি হওয়ার পর ‘আমাদের-ওদের’ ধরনের বিভাজনসূচক মনস্তত্ত্ব ক্রমেই অপসৃত হয়। তখন দুই পারের মানুষ অভিন্ন হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে শুধু যে মনস্তাত্ত্বিক নৈকট্য তৈরি হয়, তা-ই নয়; তাদের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সাম্যের পথও খুলে যায়।

দেশে এখনো বহু নদীবেষ্টিত গ্রাম আছে, যেগুলোর ললাটে শুধু একটি সেতুর অভাবে ‘প্রত্যন্ত’ কিংবা ‘পশ্চাৎপদ’ তকমা এঁটে আছে। খেয়া পারাপারনির্ভর জীবন সেখানকার মানুষকে আধুনিক জীবনব্যবস্থা থেকেও পিছিয়ে রেখেছে। কিন্তু কেবল একটি সেতু নির্মিত হলেই পুরো এলাকার মানুষের প্রাত্যহিক জীবনধারা খোলনলচে বদলে যেতে পারে—এই অতি পুরোনো কথাকে আবারও সত্যে রূপ দিয়েছে মানিকগঞ্জের কালীগঙ্গা নদীর ওপর বানানো একটি সেতু।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনের সুবাদে জানা গেল, চার বছর আগেও কালীগঙ্গা নদী সাটুরিয়া উপজেলার তিল্লিসহ আশপাশের কয়েকটি ইউনিয়নকে জেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। নদীর ওপর সেতু না থাকায় ওই সব জনপদ ছিল অনুন্নত, অবহেলিত। কৃষক তখন উৎপাদিত কৃষিপণ্য সহজে বাজারজাতকরণ করতে পারতেন না। এসব এলাকার মানুষকে জেলা সদরে যাওয়া-আসা করতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হতো। সেখানকার মানুষ আর্থিক সচ্ছলতার দিক থেকে মানিকগঞ্জ সদর এলাকার বাসিন্দাদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল। কিন্তু সেতু নির্মিত হওয়ার চার বছরে দেখা যাচ্ছে, সেই অনুন্নত গ্রামগুলো ও আশপাশের চিত্র এখন অনেকটাই বদলে গেছে।

এসব গ্রামের মানুষ এখন অনায়াসে জেলা সদরে যাতায়াত করতে পারছে। কৃষক তাঁর ফসল হাটবাজারে নিতে পারছেন। আগে এলাকায় পাকা সড়ক ছিল না। সেতু নির্মিত হওয়ায় এসব এলাকার রাস্তাঘাটও এখন পাকা হয়েছে। সেতু হওয়ায় আশপাশের এলাকায় কৃষিব্যবস্থাসহ অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। অনেক কৃষক পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে। আগে সেতুর অভাবে অনেক সময় লোকসানে সবজি ও ফসল বিক্রি করতে হয়েছে। আগে অফিস-আদালতে যাওয়া-আসা করতেই সারা দিন চলে যেত। সেতুর কারণে যাতায়াত এখন অনেক সহজ হয়েছে।

কালীগঙ্গা সেতুর উপযোগিতাকে আদর্শ হিসেবে ধরে নিয়ে শুধু সেতুর অভাবে কোনো কোনো এলাকার মানুষ পিছিয়ে আছে, সরকার সে বিষয়ে জরিপ চালিয়ে দেখতে পারে। এর আলোকে অগ্রাধিকারভিত্তিক এলাকায় সেতু তৈরি করতে পারলে গোটা দেশের আলোকিত হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।