এই সেতু কেন খালের পাশে?

খালের পাশে সেতুর এই ছবি প্রকাশ করেছে বাংলা ট্রিবিউন
খালের পাশে সেতুর এই ছবি প্রকাশ করেছে বাংলা ট্রিবিউন

এই ছবি দেখুন। ছবিটি প্রকাশ করা হয়েছে বাংলা ট্রিবিউন–এ। বেশ কয়েক বছর আগে প্রথম আলো একটা মলাট বের করেছিল, ‘সেতুসংখ্যা’। তাতে আমরা দেখেছিলাম নানা রকমের সেতু, অর্ধসমাপ্ত, অসমাপ্ত। সমাপ্ত কিন্তু সড়ক নেই, অ্যাপ্রোচ রোড নেই, কাজেই লোকে নৌকা দিয়ে চলাচল করে। সেতুর পাশে আরেকটা সেতু।

কিন্তু এই সেতুটার ছবি দেখে আমার আর রাতে ঘুম আসছে না। নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের এই সেতুর ছবি দেখে মাথার মধ্যে একটাই প্রশ্ন, সেতুটা খালের ওপর দিয়ে না বানিয়ে খালের পাশ দিয়ে বানানো হলো কেন? মানে সেতু তো হবে নদী বা খালের আড়াআড়ি, সমান্তরাল তো হবে না। এই সেতুটা কেন খালের সমান্তরাল করে বানানো হলো?

এই রাস্তাটা যদি সেতুটার সঙ্গে মিলিয়েও দেওয়া হয়, তাহলেও তো কোনো লাভ হচ্ছে না। তখন প্রশ্ন উঠবে, সেতুটা কেন বানানো হলো?

এই সব ভাবতে গিয়ে রাতের ঘুম আমার হারাম হয়ে গেছে।

ইয়ার্কি ডট কম নামে একটা রসিকতার সাইট আছে। তারা বলেছে, সেতুটি এই রাস্তার সঙ্গে মিলেছে প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা যে সমান্তরাল জগতের কথা কল্পনা করেন—এই পৃথিবীর মতো আরেকটা পৃথিবী কোথাও আছে—সেই পৃথিবীতে এই রাস্তা মিলে গেছে সেতুর সঙ্গে। এই সেতু আর রাস্তা গান গাইতে পারে: মরণের পরে যদি জীবন থাকে, সে জীবনে প্রিয়া তুমি আবার হবে।

এই মুহূর্তে সেতু নিয়ে যেসব কৌতুক আমরা জানি, তা আবার স্মরণ করতে পারি।

নেতা বললেন, আপনাদের গ্রামে আমি সেতু উপহার দেব।

জনসাধারণ বলল, আমাদের গ্রামে তো কোনো নদী নাই।

নেতা বললেন, প্রথমে নদী বানাব। তার ওপরে সেতু হবে।

বাংলাদেশের নেতা গেলেন চীনে। চীনের নেতা তাঁকে তাঁর বাসভবনে দাওয়াত করলেন। বাড়ি দেখে বাংলাদেশের নেতা অবাক। এত শান–শওকত। তিনি বললেন, কীভাবে পারলে তুমি এত দামি একটা বাড়ি বানাতে?

চীনের নেতা বাংলার নেতাকে তাঁর বাড়ির বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বললেন, ওই দেখো। কী দেখতে পাও?

একটা সেতু।

ওই সেতুর টেন পারসেন্ট দিয়ে হয়েছে এই বাড়ি।

চীনের নেতা এলেন বাংলাদেশে। বাংলার নেতা তাঁকে তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন। বাড়ি দেখে চীনা নেতা অবাক। কীভাবে পারলে?

ওই দেখো, কী দেখতে পাও?

কিছু দেখতে পাই না।

ওইখানে একটা সেতু হওয়ার কথা ছিল। এই বাড়ি হলো তার হানড্রেড পারসেন্ট।

একটা খাল কাটার কথা। টাকা বরাদ্দ হয়েছে। প্রকল্প কর্তারা খাল কাটলেন না। পুরো টাকা আত্মসাৎ করলেন। কদিন পরে ইন্সপেক্টর আসছেন খাল দেখতে।

কর্তাদের মাথায় হাত। এখন কী হবে?

তখন তাঁরা চিঠি লিখলেন হেড অফিসে। আমাদের এলাকায় একটা খাল কাটার ফলে খুব অসুবিধা হচ্ছে। মশার কারণে ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। বন্যায় মানুষের কষ্ট হচ্ছে। এটা ভরাট করতে হবে। প্রকল্প প্রণীত হলো। বাজেট বরাদ্দ হলো। ইন্সপেক্টর এলেন। এসে দেখলেন, বাহ্‌। কাটা খাল নিখুঁতভাবে ভরাট করা হয়েছে। কাজটা এত সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে যে মনেই হচ্ছে না এখানে কখনো কোনো খাল ছিল।

নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। আগেকার পরিকল্পনামন্ত্রী এখন হয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, প্রথম ছয় মাসে এডিপির টাকা খরচ করা যায়নি তেমনভাবে। তিনি কাজের গতি বাড়াবেন।

আসলেই আমাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। টাকা খরচ করার দক্ষতা।

সাঁকো নিয়ে একটা প্রবাদ আছে, পাগলকে কেন মনে করিয়ে দিলে, ওরে পাগল, সাঁকো নাড়াস না।

হ‌ুমায়ূন আহমেদের একটা সায়েন্স ফিকশন গল্প পড়েছিলাম। একটা রোবট খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। একে থামানো দরকার। তখন তার মালিক তাকে বলল, একটা প্রশ্নের সমাধান করো। একটা সাপ তার লেজ খেতে শুরু করল। লেজ খেতে খেতে সে মাথা পর্যন্ত আসছে। এরপর কী হবে?

এই দুশ্চিন্তায় রোবট হ্যাং করল।

আমার মাথা হ্যাং করছে। ওপরের ছবির সেতুটা কেন খালের আড়াআড়ি না বানিয়ে সমান্তরাল বানানো হলো! আমার মাথায় সবকিছু জট পাকিয়ে যাচ্ছে...

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক