বিএনপি এখন কী করবে?

বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়ে গেল। এ নিয়ে অ্যানাটমি চলছে, চলবে। যাঁরা জয়ী হয়েছেন তাঁরা দাবি করছেন, এত সুন্দর, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিকট অতীতে হয়নি। যাঁরা হেরে গেছেন তাঁদের দাবি, তাঁদের জোর করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলধারার গণমাধ্যমকে বেশ ‘সংযত’ মনে হচ্ছে। ফেসবুকে পাওয়া যাচ্ছে নানা ধরনের তথ্য ও মন্তব্য। ১৯৭৩ সালে দৈনিক বাংলায় ‘অনিকেত’ নামে কলাম লিখতেন নির্মল সেন। তখন বেশ জোরদার একটি হরতাল হয়েছিল। তো তিনি লিখলেন—আজ হরতাল হয়েছে, আজ হরতাল হয়নি। সরকারি পত্রিকায় এর চেয়ে বেশি আর কীই–বা লেখা যায়? যাঁর যা বোঝার তিনি বুঝে নিয়েছিলেন।

স্বাধীনতার পরপর দেশের অবস্থা ছিল অন্য রকম। রাজনৈতিক দলগুলো ছিল সবল, রাষ্ট্র ছিল দুর্বল। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠতে সময় লাগে। এখন মোটামুটি টের পাওয়া যায়, চালচিত্র পাল্টে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলো কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছে। তুলনামূলকভাবে রাষ্ট্র হয়ে গেছে অনেক শক্তিশালী। আমরা এমনিতেই জানি, রাষ্ট্রের হাত অনেক লম্বা। তো সেই রাষ্ট্র যার কবজায় যাবে বা রাষ্ট্র যাকে সমর্থন দে‌বে, তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না।

গত কয়েক দশক দুই পরাশক্তি আমাদের রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছে—আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। সংসদ নির্বাচনের ফলাফল দেখে মনে হতে পারে, বিএনপি বোধ হয় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। দেশের মানুষ কী চেয়েছিল তা জানতে হলে ঘরে ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো এমনটিই চেয়েছিল। শত্রু কুপোকাত হলে কার না আনন্দ হয়? এখন আওয়ামী লীগ ও তার সুহৃদেরা আনন্দের বন্যায় ভাসছেন। চারদিকে অভিনন্দনের বান ডেকেছে। অনেকেই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে তা জানান দিচ্ছেন। হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা বলে শব্দের বোমা ফাটাচ্ছেন। বছরখানেক আগে একজন মন্ত্রী হয়েই হুংকার দিয়েছিলেন, রক্ত দিয়ে হলেও বিমানকে লাভজনক করবেন। জানি না তিনি কথা রাখতে পেরেছেন কি না। তবে তাঁর হাতে বিমানের স্টিয়ারিং হুইল এখন আর নেই।

সংসদের দিকে তাকালে মনে হবে, দেশে কোনো বিরোধী দল নেই। কাগজ-কলমে বিরোধী দল হয়েছে জাতীয় পার্টি। এই দলের সাংসদদের মন ভালো নেই। মন্ত্রী না হতে পারলে মান–সম্মান থাকে না। কিন্তু বিরোধী দল না থাকলে সংসদীয় ব্যবস্থা চলবে কী করে? তাঁরা অনেকেই বলেছেন, তাঁরা সরকারে থাকবেন না বিরোধী দলে যাবেন, এটি ঠিক করে দেবেন প্রধানমন্ত্রী। তো প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এখন জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল হয়ে ওঠার অভ্যাস করতে হবে।

আওয়ামীবৃত্তে যাঁরা আছেন, তাঁরা দশম সংসদে জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের তকমা দিলেও যথেষ্ট মর্যাদা দেননি। তাঁদের কথাবার্তায় সব সময় ছিল বিএনপির সমালোচনা। সংসদে না থেকেও সত্যিকার বিরোধী দল ছিল বিএনপি। এখন প্রশ্ন একটাই—বিএনপি কী করবে?

বিএনপির ঘরে দুটো জানালা ছিল। একটি হলো জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, অন্যটি হলো জামায়াত। ঐক্যফ্রন্টের ফেসভ্যালু ছিল বেশি। কিন্তু রাজনৈতিক গুরুত্ব বেশি পেয়েছিল জামায়াত। তাই দেখা গেল, ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের চেয়ে জামায়াতকে বেশি আসনে ধানের শীষ প্রতীক দেওয়া হয়েছিল। ফলাফল দেখা গেল, জামায়াতের থালা শূন্য। ঐক্যফ্রন্টের ভাগে দুটো লাড্ডু, দুটোই গণফোরামের পাত্রে। গণফোরামের সভাপতি কামাল হোসেনের মন্তব্য হলো, এটিও কম অর্জন নয়।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁরা সংসদে যাবেন না। গেলে কী ক্ষতি আর না গেলে কী লাভ, এটি তাঁরাই ভালো বোঝেন। কেননা দল তাঁদের। নিশ্চয়ই তাঁদের কোনো হিসাব আছে। সংসদে গেলে নির্বাচনের ফলাফলকে বৈধতা দেওয়া হয়, এটি তাঁরা জানেন। সংসদে না গেলে তাঁরা বাইরে থেকে ‘অবৈধ সংসদের’ নিন্দা-সমালোচনা চালিয়ে যেতে পারবেন বলে মনে করছেন। কিন্তু সেটাও কি পারবেন? তাঁদের তো কোথাও দাঁড়াতেও দেওয়া হচ্ছে না। ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির অন্যতম সদস্য জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, তাঁরা সংসদের ভেতরে এবং বাইরে আন্দোলন অব্যাহত রাখবেন। তাঁর কথায় ইঙ্গিত পাওয়া যায়, বিএনপি শেষমেশ সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে।

যদি এমন হয়, বিএনপির কেউ কেউ এবং গণফোরামের দুজন সংসদে গেলেন। সে ক্ষেত্রে এ নিয়ে বিএনপিতে নতুন টানাপোড়েন তৈরি হতে পারে। আমরা ১৯৯৬-এর সংসদে এমনটি দেখেছি। দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নির্দেশ অমান্য করে মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু শেখ হাসিনার ‘ঐকমত্যের সরকারের’ মন্ত্রী থেকে গিয়েছিলেন এবং সংসদীয় দলের ১২ জনকে নিয়ে আলাদা একটি গ্রুপ করেছিলেন। আমরা পরে দেখলাম, জাতীয় পার্টি তিন টুকরো হলো।

বিএনপি সংকটে আছে। এখন তারা কী কৌশল নেবে, ভবিষ্যতে কী কথা বলে জনগণের সামনে আসবে, এ নিয়ে দলের ভেতরে নিশ্চয়ই কথা চালাচালি হচ্ছে। তবে এটা অনস্বীকার্য যে দেশে আওয়ামী লীগের বাইরে একটি উদার গণতান্ত্রিক বিরোধী দলের চাহিদা আছে। বাম দলগুলো এ চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি নতুনভাবে সংগঠিত হয়ে আবার উঠে দাঁড়াতে পারবে, নাকি সমাজে নানা রসায়নের মধ্য দিয়ে নতুন রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের মতো দেশগুলোতে নাগরিক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। অতীতে নাগরিক ভাবনা এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের সম্মিলনের মধ্য দিয়ে আমরা অনেক কিছুই অর্জিত হতে দেখেছি। ১৯৪৮ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে তাঁদের হাত ধরাধরি করে চলতে দেখেছি।

এ দেশে ভুঁইফোড় রাজনীতিকের সংখ্যা যত বাড়ছে, নাগরিক সমাজের ভূমিকার বিরুদ্ধে তাঁদের বিষোদ্‌গার ততই বাড়ছে। এ জন্য নাগরিক সমাজের একটি অংশ দায়ী। পদ-পদক-পদবির মোহে তাঁরা যেভাবে ক্ষমতাসীনদের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েন, তা রীতিমতো লজ্জাজনক। এ ধরনের কাঙ্ক্ষিত পদ আছে হয়তো কয়েক শ। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক বা পরিচালক, বিভিন্ন সাংবিধানিক কমিশনের সদস্য, দূতাবাসের চাকরি বা নানা রঙের উপদেষ্টা হওয়ার সুযোগ আছে যে কজনের, প্রত্যাশীর সংখ্যা তার অনেক গুণ বেশি। সুতরাং নির্লোভ এবং বঞ্চিতদের মধ্যে একটা সংযোগ সহজেই হয়ে যেতে পারে।

জাতীয় সংসদে যে একচেটিয়া দলতন্ত্র কায়েম হয়েছে, তা ওই দলকে যত সুবিধাই দিক না কেন, সমাজের গণতন্ত্রায়ণের পথটি তাতে মসৃণ হবে না। কেউ বলতে পারেন, ‘পাবলিক ভোট না দিলে কী করার আছে?’ পাবলিক কাকে ভোট দিয়েছে, তা পাবলিকই জানে।

শুনতে পাচ্ছি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে একটি জাতীয় সংলাপ হতে যাচ্ছে। সেখানে বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে নিশ্চয়ই একটি ধারণাপত্র উপস্থাপন করা হবে। তাঁরা যদি প্রামাণ্য তথ্য-উপাত্তসহযোগে বিষয়টি তুলে ধরতে পারেন এবং যদি তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে পারে, তাহলে তার ভিত্তিতে একটি জনমত তৈরি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। আমি শুধু একটি কথাই বলব, কোনো রকম খোয়াব না দেখে, মাটির ওপর দাঁড়িয়ে তাঁরা যেন পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেন এবং প্রতিপক্ষের শক্তিকে যেন খাটো করে না দেখেন।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক