গ্রামকে যদি শহর বানাই!

গ্রাম বসবাসের জন্য আর শহর ব্যবসার জন্য। ছবি: ফারুক ওয়াসিফ
গ্রাম বসবাসের জন্য আর শহর ব্যবসার জন্য। ছবি: ফারুক ওয়াসিফ

গ্রামের লক্ষ্য কি শহর হওয়া? শহরগুলো তো এমনিতেই আমরা নষ্ট করে ফেলেছি, এবার যদি গ্রামগুলোকেও শহর বানিয়ে ফেলি, তাহলে বিষয়টি কেমন হবে? কথাগুলো বলছি এ কারণেই, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি গ্রামকে শহর করার যে ঘোষণা ইশতেহারে দিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করাই আমার প্রধান লক্ষ্য থাকবে।’ প্রশ্ন হলো, গ্রামে শহরের সুযোগ–সুবিধা প্রদান করা, নাকি গ্রামকে শহর করার পরিকল্পনা? কোনটি সঠিক? যদি প্রথমটি হয়, তাহলে একে সাধুবাদ জানানো যায় অবশ্যই।

আর যদি দ্বিতীয়টি হয়, তাহলে কিছু কথা থেকে যায় বৈকি! তবে এ কথা সত্যি, নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে আমরা অনেক কিছুই ঠিকমতো না বুঝে, না জেনে শুধু বলার জন্য বলে ফেলি অথবা করে ফেলি বিশেষ কারও দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। কারণ, অতীতেও দেখেছি, কথা ঠিকঠাক না বুঝে, না উপলব্ধি করে আমরা অনেক কিছুই হুটহাট করে ফেলি শুধু রাজনৈতিক কিছু স্বার্থ হাসিলের জন্য। আর তখনই সম্মুখীন হতে হয় হাজারো প্রশ্নের, সমালোচনার মধ্যে।

কিছুদিন আগে মেলবর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মার্ট ভিলেজ ল্যাবের আমন্ত্রণে পরিবেশ, স্থাপত্য ও মানুষবিষয়ক একটি ওয়ার্কশপ পরিচালনা করার জন্য গিয়েছিলাম ভারতের আসামের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের ওয়ার্কশপ পরিচালনার প্রধান ছিলেন মেলবর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক ও গবেষক ড. মাসা নগুচি। ওয়ার্কশপটির মূল চিন্তা ছিল গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার কী কী স্বাভাবিক পরিবর্তন আনলে তারা সুন্দর ও পরিবেশবান্ধব অবস্থানে তাদের বসতবাড়িতে বসবাস করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে তাদের পর্যবেক্ষণ করে, তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে ও জীবনযাত্রা উপলব্ধি করে কাজগুলো করতে হবে। কারণ, পরিবেশদূষণের হাত থেকে শুধু শহরের জীবনযাত্রাকে রক্ষা করাই শেষ কথা নয়, বাঁচাতে হবে গ্রামের সাধারণ জনগোষ্ঠীকে। খেয়াল রাখতে হবে তাদের স্বাস্থ্যের দিকেও।

আর এই গ্রামগুলোকে রক্ষার জন্য মেলবর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আসামের স্থানীয় সরকারের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার মূল সমন্বয়ক ড. হেমন্ত দালই। পরবর্তী সময়ে সেখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স, যেখানে গ্রামের বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে গবেষণার ফলাফল প্রদর্শিত হয়েছে। সেই সঙ্গে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামকে আরও কীভাবে পরিবেশবান্ধব করা যায়, সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। ভাবলাম, আমাদের দেশের গ্রামগুলো নিয়ে এমন তো অনেক কিছুই করা যায়!

বছরখানেক আগে ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭–তে প্রথম আলোর মতামতে লিখেছিলাম, ‘গ্রামগুলো যেন শহর না হয়!’ লেখার উদ্দেশ্য ছিল, গ্রামের উন্নয়ন অবশ্যই প্রয়োজন। এমনকি শহরকেন্দ্রিক সব সুযোগ–সুবিধা অল্প পরিসরে হলেও গ্রামগুলোতে থাকা প্রয়োজন। এককথায়, শহর ও গ্রামের মধ্যে সুযোগ–সুবিধার বৈষম্য কমানো। যেমন ধরা যাক, একটি গ্রামে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর নাগরিক প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে কিছু সুযোগ–সুবিধা এবং অবকাঠামো থাকা প্রয়োজন। যেমন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, এমনকি মুদিদোকান কিংবা লাইব্রেরি। কিন্তু সেটি হতে হবে নির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে, নির্দিষ্ট গ্রামের রূপরেখার কথা চিন্তা করে। কারণ, আমাদের প্রতিটি গ্রামে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্য, যা একটি থেকে আরেকটিকে আলাদা করে।

গ্রাম উন্নয়নে এগুলোর চিন্তা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। যেখানে–সেখানে ইট পাথরের বড় বড় অট্টালিকা বানানো ও অপরিকল্পিত রূপরেখা মারাত্মকভাবে হুমকিস্বরূপ পরিবর্তন আনতে সক্ষম। তখন আজ যেমন আমরা আমাদের শহরগুলোকে বসবাসের অনুপযোগী করে ফেলছি, ঠিক তেমনিভাবেই গ্রামগুলোও একদিন নষ্ট হবে। দিন শেষে আমাদের হাঁফ ছেড়ে বাঁচার আর কোনো জায়গা থাকবে না। স্পষ্ট করে বললে, এখনো আমাদের ভিন্ন ভিন্ন শহর, মফস্বল কিংবা গ্রামকেন্দ্রিক স্থাপত্যের নিজস্ব প্যাটার্ন বা রূপরেখা নেই, যা একে অপরের থেকে নিজস্ব রীতিনীতি, ভাবধারা কিংবা পরিবেশগত কারণে ভিন্নতর, যা সত্যিই অনভিপ্রেত। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই গ্রাম কিংবা মফস্বল নামক বস্তুর অস্তিত্ব এক রকম যে বিলীন হবে, সেটি আজকের অবস্থান থেকে নির্দ্বিধায় বলা যায়!

অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের গ্রামগুলোর আবাসন এবং দূষণের ক্ষেত্রে পরিবেশগত উন্নয়নের চিন্তা এবং এসব বিষয়ে আরও কাজ কীভাবে করা যায়, গবেষণা করা যায়, এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ল্যাব স্থাপন আমাদের দেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মপরিকল্পনার মধ্যে বিদ্যমান। তা ছাড়া এ–ও জানা গেল, পরিবেশদূষণের হাত থেকে গ্রামের মানুষকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, ল্যাব পর্যায়ে নতুন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে গবেষণার ভিত্তিতে বিভিন্ন স্থাপনার নকশা প্রণয়নের মাধ্যমে এগুলো করা সম্ভব বৈকি আমাদের দেশেই! তবে প্রয়োজন পর্যাপ্ত অর্থায়ন এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। প্রয়োজন শুধু কাগজে–কলমের গবেষণার মধ্যে না থেকে প্রায়োগিক গবেষণা। এসব ক্ষেত্রে, বিশেষ করে গ্রাম উন্নয়নে গৃহায়ণ ও গণর্পূত বিভাগ আমাদের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে পারে।

এ কথা সত্যি, সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব গ্রামোন্নয়নের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে, যা বিগত বছরগুলো থেকে আলাদা। এমনকি গ্রামগুলোতে সব ধরনের সুযোগ–সুবিধার কথা বলা হয়েছে। এবারের ইশতেহারে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, পল্লি উন্নয়নের লক্ষ্য হবে গ্রামাঞ্চলে কর্মসৃজন, গ্রামাঞ্চলে নাগরিক সুযোগ–সুবিধার বিস্তৃতি সাধন এবং গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনের হার কমিয়ে আনা। প্রতিটি ইউনিয়ন সদরকে পরিকল্পিত পল্লি জনপদ হিসেবে গড়ে তোলা হবে। আবাসন, শিক্ষা, কৃষিনির্ভর শিল্পের প্রসার, চিকিৎসাসেবা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানীয় জল ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থার মাধ্যমে উপজেলা সদর ও বর্ধিষ্ণু শিল্পকেন্দ্রগুলোকে আধুনিক শহর-উপশহর হিসেবে গড়ে তোলা হবে।

আর এটি যদি প্রথম দিন থেকেই সঠিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে এগোয়, তাহলে প্রথমেই প্রয়োজন ইকো ভিলেজ কিংবা স্মার্ট ভিলেজ কনসেপ্ট স্থাপন, যা করতে হবে গ্রাম্য পরিকল্পনার প্রতিটি পর্যায়ে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন অভিজ্ঞ গবেষকদের পর্যাপ্ত সুযোগ প্রদান—পড়ে থাকা গ্রামগুলোকে নিয়ে ভাববার ও প্রায়োগিক গবেষণা করার। প্রতিটি গ্রামে একটি সমন্বিত কর্ম–কমিটির মাধ্যমে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে বৃহৎ পরিকল্পনার চেয়ে ক্ষুদ্র ও স্বল্প সময়ের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং দ্রুত বাস্তবায়নই হবে সব থেকে বেশি কার্যকর। এমনকি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদ-নদী, গভীর-অগভীর জলাধার সংরক্ষণ নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ এগুলো রক্ষা করতে না পারলে গ্রামগুলোকে বাঁচানো সম্ভব নয়। তাহলেই হয়তো গ্রামগুলো তার নিজস্ব স্বরূপ সঙ্গে নিয়ে শহর না বানিয়েও সামনের দিকে চলতে পারবে, নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে গ্রামগুলোতে। দূষণযুক্ত শহরে না এসে গ্রামেই নতুন চিন্তা নিয়ে বসবাস করবে সাধারণ মানুষ।

সজল চৌধুরী: চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।
[email protected]