ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফলাফল কী প্রমাণ করে?

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া জয়ী হয়েছেন। ছবি: সংগৃহীত
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া জয়ী হয়েছেন। ছবি: সংগৃহীত

সারা দেশে যখন বিএনপির ভূমিলীন পরাজয় ঘটেছে তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের ফল ভিন্ন বার্তা দেয়। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন না। মহাজোটের প্রার্থী ছিলেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের যুববিষয়ক উপদেষ্টা ও দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি মঈনউদ্দিন মঈন ও জিয়াউল হক মৃধা। মহাজোটের প্রার্থী রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়াও শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। নির্বাচনের দুই দিন আগে তিনি তাঁর শ্বশুর জিয়াউল হক মৃধার সম্মানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে আসেন।

জিয়াউল হক মৃধা মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় বিএনপির প্রার্থী আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া ও আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা মঈনউদ্দিনের মধ্যে। মঈনউদ্দিন স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন। সেখানকার আওয়ামী লীগের সমর্থক ভোটাররা নিশ্চয়ই বিএনপির প্রার্থীকে ভোট দেননি। আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ থেকে বরাবর বিএনপির বা চারদলীয় জোটের প্রার্থী জিতেছেন, এ কথাও সত্য নয়। ২০০৮ সালে মুফতি ফজলুল হক আমিনীকে হারিয়ে মহাজোট প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও আশুগঞ্জ) আসনে ধানের শীষের প্রার্থী আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া এর আগে এই আসন থেকে একাধিকবার বিজয়ী হলেও তিনি ডাকসাইটে কোনো নেতা নন। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তও সব সময় মানেননি। ১৯৮৬ সালে বিএনপি ভোট বর্জন করলেও তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচিত হন ১৯৯১ সালে। আবার ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ও ১২ জুন—দুটি নির্বাচনেই জয়ী হন তিনি।

২০০১ সালের নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোটের তৎকালীন চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনীকে আসনটি ছেড়ে দিয়েছিল বিএনপি। পরে আবদুস সাত্তারকে টেকনোক্র্যাট কোটায় ভূমি প্রতিমন্ত্রী করেছিলেন খালেদা জিয়া।
আবদুস সাত্তার ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে ২২ বছর পর আবার ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। যেখানে বিএনপির দেড় শতাধিক প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে ৮ হাজার ভোটে তাঁর জয়ী হওয়া ব্যতিক্রমী ঘটনাই বটে। কেন এমনটি হলো? ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের দিন সারা দেশের বিএনপির ভোটাররা কী এই আসনে এসে ভিড় করেছিলেন? যদিও ভোটার আইডি কার্ড চালু হওয়ার পর এক স্থানের ভোটার আরেক স্থানে গিয়ে ভোট দিতে পারেন না।

৯ জানুয়ারি স্থগিত তিন কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের পর দেখা যায়, ধানের শীষের প্রার্থী আবদুস সাত্তার স্বতন্ত্র প্রার্থী মঈনউদ্দিনকে ৮ হাজার ৫৭৮ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন। ১৩২ কেন্দ্রের ফলাফলে আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া পেয়েছেন ৮৩ হাজার ৯৯৭ ভোট। অন্যদিকে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মঈনউদ্দিন মঈন পেয়েছেন ৭৫ হাজার ৪১৯ ভোট।

জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে ৩০ ডিসেম্বর ভোট গ্রহণের দিন অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার কারণে আশুগঞ্জ উপজেলার তিনটি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। এর আগে ১৩২টির মধ্যে ১২৯টি কেন্দ্রে আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া পেয়েছিলেন ৮২ হাজার ৭৩২ ভোট। মঈনউদ্দিন  পেয়েছিলেন ৭২ হাজার ৫৬৪ ভোট। এই তিনটি কেন্দ্রে ১০ হাজার ৫৭৪ ভোটের মধ্যে বুধবার ৪ হাজার ৩০০ ভোট পড়েছে। এর মধ্যে কলার ছড়ি প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী মঈনউদ্দিন পেয়েছেন ২ হাজার ৮৫৫ আর ধানের শীষের প্রার্থী পেয়েছেন ১ হাজার ২৭৪ ভোট।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাতজন প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার জয়ের পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের জয়ী প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়াল আটে। তবে ৩০ ডিসেম্বরে জয়ী সাত প্রার্থী এখনো শপথ নেননি। আবদুস সাত্তার জানিয়েছেন, তিনিও দলের সিদ্ধান্ত মেনে চলবেন।

এর আগে আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ জন্য তিনি প্রতিপক্ষ স্বতন্ত্র প্রার্থীর লোকদের দায়ী করেছেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, কোনো কারণ ছাড়াই স্বতন্ত্র প্রার্থী মঈনউদ্দিনের সমর্থকেরা তাঁর গাড়িতে অতর্কিত হামলা চালান। এ ব্যাপারে তিনি নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

হামলার বিচার হবে কি না, সেটি আইন আদালতের বিষয়। আমরা বিস্মিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভোটের ফলাফলে। এটি তো বাংলাদেশেরই একটি জেলা। এখানে যদি বিজয়ী প্রার্থী ও বিজিত প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান ৮ হাজার হয়ে থাকে, অন্যান্য জায়গায় দেড় দুই লাখ হলো কীভাবে? বিজয়ী ১১০ জন প্রার্থী নিজ নিজ আসনে যে ভোট পড়েছে, তার ৯১ শতাংশই পেয়েছেন। ৮৯ জন পেয়েছেন ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ভোট। নির্বাচনে জয়–পরাজয় যা–ই হোক না কেন, ভোটের এই ব্যবধান ঠিক মেলানো যায় না।

বিজয়ী আওয়ামী লীগের নেতারা বলতে চাইছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপি শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের ফল বোধ হয় অন্য কথা বলছে।