নতুন নাগরিকত্ব বিল: হিন্দুকরণই আসল লক্ষ্য

ভারতের পার্লামেন্ট। রয়টার্স ফাইল ছবি
ভারতের পার্লামেন্ট। রয়টার্স ফাইল ছবি

৮ জানুয়ারি ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় একটি বিল পাস হয়েছে, যা বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া সংখ্যালঘু অমুসলিম অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দেবে। এই বিলের বিরুদ্ধে উত্তর-পূর্ব ভারতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। মূলত আসাম রাজ্যে বেশি বিক্ষোভ হয়েছে, যেখানে গত বছর বিদেশি আখ্যা দিয়ে বহু মানুষের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়।

বিতর্কিত নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিলটি লোকসভায় পাস হলেও এখনো রাজ্যসভায় পাস হয়নি। তিনটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিষ্টানদের ভারতের নাগরিকত্ব দিতে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে নতুন এই নাগরিকত্ব বিল তৈরি করা হয়েছে। সংশোধিত বিল অনুযায়ী, এসব ধর্মের লোকজন, যাঁরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া ২০১৪ সালের আগে ভারতে প্রবেশ করেছেন, তাঁদের কারাবন্দী বা বিতাড়িত করা হবে না এবং ভারতে ছয় বছর বসবাসের পর তাঁরা স্থায়ী নাগরিকত্ব পাবেন।

ভারত সরকার বলছে, ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে যাঁরা নিজ দেশে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং ভারত ছাড়া যাঁদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, তাঁদের সাহায্য করাই নতুন এই নাগরিকত্ব বিলের লক্ষ্য।

ধর্মকে ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার মাপকাঠি হিসেবে নির্ধারণ করায় এই বিল ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। অনেকে বলছেন, এটা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের ওপর একটি বড় আঘাত।  ধর্মের কারণে নির্যাতনের শিকার হলে সবাইকে আশ্রয় দেওয়া উচিত ভারতের।

কেউ কেউ বলেছেন, বিলটিতে শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মিয়ানমার থেকে আসা হাজার হাজার অভিবাসীর সুরক্ষার বিষয়টিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে বসবাস করে না, এমন সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে ভারত সরকারের খুব একটা মাথাব্যথা নেই।

প্রকৃতপক্ষে, যখন মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমান রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ের জন্য নির্যাতিত হওয়ার পর ভারতে আশ্রয় চেয়েছিল, তখন ভারত সরকার তাদের জন্য কোনো আইনি সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেনি। উল্টো তারা রোহিঙ্গাদের ভারতের জন্য হুমকি মনে করে তাদের দেশ থেকে জোর করে তাড়ানোর চেষ্টা করেছে।

এই প্রেক্ষাপটে, মানবিক কারণে এই বিল পাস করা হয়েছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। তাহলে এই বিলকে সমর্থন করার জন্য ভারত সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী?

ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির উত্তর-পূর্বাঞ্চলবিষয়ক প্রধান কুশলী ও আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সম্প্রতি বিলটির প্রকৃত উদ্দেশ্য উন্মোচন করেছেন। আর সেটা হচ্ছে, ভারতের তথাকথিত হিন্দু পরিচয় রক্ষা করা।

নাগরিকত্ব বিলটি লোকসভায় উত্থাপনের আগে শর্মা বলেন, ‘এই বিলটি যদি পাস না হয়, তাহলে আসামের হিন্দুরা আগামী মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে সেখানে সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। আর এটা তাদের জন্য লাভজনক হবে, যারা আসামকে আরেকটি কাশ্মীর বানাতে চায় এবং রাজ্যটিকে অস্থিতিশীল করতে চায়।’

লোকসভায় বিলটি পাসের পর মুখ্যমন্ত্রী শর্মা বলেন, এই বিল আসামের বিধানসভার ১৭টি আসন মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়াকে প্রতিহত করবে
এবং এর ফলে অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের মুসলিম নেতা বদরুদ্দিন আজমল আর মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন না।

শর্মার এসব কথায় স্পষ্ট বোঝা গেছে যে এই নাগরিকত্ব বিল কাউকে রক্ষা করার জন্য নয়, বরং হিন্দুদের আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই তৈরি
করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এর আগে স্বীকার করেছেন যে এই বিল পাস করা হচ্ছে তাঁর দলের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী। আর সেটা হচ্ছে, ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা, যেখানে হিন্দুদের অধিকার অগ্রাধিকার পাবে।

আসামের বাঙালি হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল শিলচরের এক সমাবেশে মোদি বলেছেন, নাগরিকত্ব বিলটি ‘অতীতের ভারত ভাগের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত’।  তিনি এই অঞ্চলের বাঙালি ভাষাভাষী হিন্দুদের প্রতিশ্রুতি দেন যে এই বিল পাসের মাধ্যমে তাদের ভারতে স্বাগত জানানো হবে। তবে মোদির কথায় আসামের হিন্দুদের মন ভিজেছে, এমনটা মনে হচ্ছে না।

বিলের বিরোধিতা করে বিজেপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) ছেড়েছে আসামের রাজনৈতিক দল অসম গণপরিষদ (অগপ)। অগপ এবং তার মিত্রদের মতে, এই বিল পাসের ফলে বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় পাবে। এতে এই অঞ্চল বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত হবে এবং স্থানীয় সংস্কৃতি হারিয়ে যাবে।

বিলটি আসলে ভারতে ‘হিন্দু রাষ্ট্রে’ রূপান্তর করার জন্য বিজেপির বৃহত্তর মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ । ভবিষ্যতে যদি বিলটি রাজ্যসভায় পাস হয়, তবে তা শুধু ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দ্বন্দ্বের সৃষ্টিই করবে না, বরং ভারতে চলমান হিন্দুকরণ প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: রোকেয়া রহমান

অপূর্বানন্দ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি বিভাগের অধ্যাপক