অভিনন্দন-সংস্কৃতি

নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পর ক্ষমতাসীন দল, সাংসদ, নেতা-কর্মী এবং প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানানোর হিড়িক পড়েছে। নতুন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের অভিনন্দন জানানো দোষের কিছু নয়, যদি সেটি বাহুল্যবর্জিত ও অনাড়ম্বর হয়। কিন্তু আমাদের দেশের সংস্কৃতি হলো কাজের চেয়ে কথা বেশি। আয়োজনের চেয়ে আড়ম্বর বেশি।

এখন যাঁরা নতুন মন্ত্রীদের শুভেচ্ছার ডালিতে বরণ করতে উদ্‌গ্রীব, তাঁরাই পাঁচ বছর আগে পূর্বসূরিদের অভিনন্দনের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে ব্যস্ত ছিলেন। এ ধরনের অভিনন্দন ও সংবর্ধনার দুটি উদ্দেশ্য থাকে। প্রথমত আন্তরিকতা ও আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে পদাধিকারীর সাফল্য কামনা। দ্বিতীয়ত সংবর্ধিত ব্যক্তিকে খুশি করে ভবিষ্যতে সুবিধা আদায়ের পথ প্রশস্ত করা। দেশের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে মন্ত্রীদের অভিনন্দন জানানো ও সংবর্ধনার প্রতিযোগিতা চলছে, তাতে দ্বিতীয়টির পাল্লাই ভারী বলে ধারণা করি।

বিভিন্ন স্থানে সংবর্ধনা সভা আয়োজনের পাশাপাশি সংবাদপত্রেও বিজ্ঞাপন দিয়ে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের অভিনন্দন জানানো হচ্ছে। এর মাধ্যমে শুধু অভিনন্দিত ব্যক্তি নয়, অভিনন্দনকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নাম প্রচারেরও সুবর্ণ সুযোগ খুলে গেছে। আবার এই অভিনন্দনবার্তার মধ্য দিয়ে একটি মনস্তাত্ত্বিক চাপও লক্ষ করা যায়। যখন কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষামন্ত্রীকে কিংবা কোনো বেসরকারি ব্যাংক অর্থমন্ত্রীকে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে অভিনন্দন জানায়, তখন সমমাত্রিক অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা করার তাগিদ বোধ করে।

আরও উদ্বেগের বিষয় হলো এ ধরনের প্রতিযোগিতা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমিত নেই। গত কয়েক দিনে বেশ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছে। যেহেতু প্রতিষ্ঠানের নামে বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে, ধরে নিতে পারি এর খরচও তারা বহন করেছে। অর্থাৎ জনগণের করের পয়সা দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছে। অর্থমন্ত্রী সংসদে যেই বাজেট পেশ করেছেন, তাতে মন্ত্রীকে অভিনন্দন জানানোর জন্য আগাম কোনো বরাদ্দ রাখেননি। সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ হওয়া ওই অর্থ অন্য কোনো খাত থেকে কেটে নিতে হয়েছে বা হবে। এখানেও অসুস্থ প্রতিযোগিতার আশঙ্কা আছে। ধরা যাক, কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১০টি প্রতিষ্ঠান আছে এবং তার মধ্যে কোনো একটি বিজ্ঞাপন দিয়ে মন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাল। তখন অন্যরাও পিছিয়ে পড়তে চাইবে না।

একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হলো সরকারের নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা। ওই প্রতিষ্ঠান বা তার পদাধিকারীরা যদি সেই কাজ সুচারুভাবে করতে পারেন, সেটাই হতে পারে সরকার বা মন্ত্রীর জন্য বড় অভিনন্দন। দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো কোনো মন্ত্রী তাঁদের মন্ত্রণালয়ের অতীতের বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করার কথা বলেছেন। ধারণা করি, তাঁরা তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতেই কথা বলেছেন। এখন তাঁদের কর্তব্য হবে যঁাদের কারণে মন্ত্রণালয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া।

অভিনন্দনে সিক্ত বা তোষামোদে বিভোর না হয়ে নতুন মন্ত্রীদের দায়িত্ব হবে মন্ত্রণালয়ের অতীত ব্যর্থতা, অনিয়ম–দুর্নীতির একটি চুলচেরা বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যতের করণীয় নির্ধারণ। যাঁদের কারণে পূর্বসূরিকে ব্যর্থতা, বিশৃঙ্খলা ও অনিয়মের দায় নিতে হয়েছে, তাঁদের বিষয়ে সজাগ না হলে উত্তরসূরিকে একই ফল ভোগ করতে হতে পারে।

নতুন সরকারের নতুন মন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েছেন। আশা করি, তাঁরা প্রশাসনে তোষামোদের পুরোনো সংস্কৃতি ও ব্যাধি আঁকড়ে থাকবেন না।