কাজ চাই ভালো কাজ

দেশে নতুন সরকার গঠিত হলো। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সামনে কী চ্যালেঞ্জ, কী করা উচিত—এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা, লেখালেখি ইত্যাদি শুরু হয়ে গেছে। আমিও আমার সামান্য আরজি পেশ করছি।

নতুন সরকার যে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ওপর জোর দেবে, তা বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না। উন্নয়ন মানে যে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, সামাজিক দিকগুলোও যে গুরুত্বপূর্ণ—সেটি এখন সবাই স্বীকার করে। তবে সামাজিক উন্নয়নের বাক্সটি খুলে দেখার এবং তাতে কী রয়েছে, সে বিষয়ে বোধ হয় আলোচনার অবকাশ আছে। এ প্রসঙ্গে এসে যায় কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গটি।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়া সত্ত্বেও কর্মসংস্থানের ব্যাপারে যে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, এটিও এখন অনেকে স্বীকার করছেন। বিশেষ করে, তরুণদের কর্মসংস্থানের সমস্যাটি বেশ কিছুদিন ধরে আলোচিত হচ্ছে। তাদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করব, বেকার ভাতার ব্যবস্থা করব—এ ধরনের বক্তব্যও শোনা গেছে। তবে কীভাবে সেসব করা হবে, তা শোনা যায়নি (হয়তো নেপথ্যে রয়ে গেছে বিস্তারিত ব্যবস্থাপত্র)।

কর্মসংস্থান কেন একটি চ্যালেঞ্জ? দেখা যাক উপাত্ত কী বলে। ২০০৫-২০১০ সময়কালে প্রতি ১ শতাংশ জিডিপি বাড়ার ফলে কর্মসংস্থান বেড়েছিল শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ। ২০১০-২০১৭ সময়কালে তা কমে গিয়ে দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ২৫-এ। শিল্প খাতে ২০০৫-২০১০ সময়ে প্রতিবছর গড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছিল। আর ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৬-১৭ বছরে হয়েছে মাত্র দুই লাখ। অথচ শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির হার কিন্তু কমেনি। আমাদের প্রধান শিল্প তৈরি পোশাক খাতে ২০১১-১২ সালের পর থেকে আর কর্মসংস্থান বাড়েনি, যদিও উৎপাদন ও রপ্তানি বেড়েছে। তার মানে এই যে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কর্মসংস্থান বাড়ানোর ক্ষমতা কমে গেছে। ভবিষ্যতে এই ধারা পাল্টানো যাবে কি না, সেটি একটি বড় প্রশ্ন, কারণ বিভিন্ন খাতের উৎপাদনে যন্ত্রের ব্যবহার ও স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। জোর করে অথবা অনুনয়–বিনয় করে এই প্রবণতা রোধ করা যাবে কি না জানি না (যদিও ভুল নীতিমালার কারণে যেন তা বেড়ে না যায়, সেটি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে)।

বিদেশের চাকরি আমাদের জন্য বিরাট সাশ্রয়ের ব্যাপার। তবে গত দুই বছরের উপাত্ত থেকেই বোঝা যায়, এর ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা আমাদের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। ২০১৭ সালে ১০ লাখেরও বেশি লোক গিয়েছিল বিদেশে চাকরি নিয়ে; ২০১৮ সালে সে সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত লাখেরও কম। তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার এমনিতেই সাধারণের চেয়ে বেশি ছিল; গত কয়েক বছরে তা আরও বেড়েছে। এটি যে শুধু শ্রমশক্তির অপচয়, তা–ই নয়; সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে।

কর্মসংস্থানের এই চ্যালেঞ্জের মুখে সরকার কী করতে পারে? সরকার কি নিজেই কর্মসংস্থান সৃষ্টির দায়িত্ব নিতে পারে? হয়তো সরকারি খাতের কোথাও কোনোভাবে কয়েক হাজার চাকরি সৃষ্টি করতে পারে, অথবা কোনো বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে আরও কিছু কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু এভাবে লাখ লাখ লোকের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে না। আসলে যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে, কর্মসংস্থানের জন্য একটি সার্বিক কর্মনীতি বা কৌশল, যাতে থাকবে নীতিমালার মাধ্যমে ব্যক্তি খাতকে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রণোদনা দেওয়া এবং সরকারি খাতে কিছু কর্মসূচির মাধ্যমে সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।

মনে রাখতে হবে যে তরুণদের বেকারত্ব সার্বিক বেকারত্ব থেকে আলাদা কোনো সমস্যা নয়, যদিও তরুণদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কিছু বাড়তি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সুতরাং শুরু করতে হবে সার্বিকভাবে সমস্যাটি মোকাবিলা করার একটি কর্মনীতির মাধ্যমে। তাতে থাকতে হবে সামষ্টিক নীতিমালা থেকে শুরু করে খাতভিত্তিক নীতিমালা এবং শ্রমবাজার–সংক্রান্ত নীতিমালা।

সামষ্টিক নীতিমালা কেন জরুরি? একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কোনো কর্মসূচির অর্থায়নের জন্য প্রয়োজন বাজেট বরাদ্দ; তার জন্য চাই রাজস্ব আয়। রাজস্ব আয় না বাড়াতে পারলে খাতওয়ারি পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমেও অর্থের জোগানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

কোনো কোনো সময় সরকার কর রেয়াতের মাধ্যমে কোনো খাতকে প্রণোদনা দিয়ে তার প্রসার ঘটিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে। তবে এটি একটি রক্ষণশীল নীতি। প্রগতিশীল ঘরানার সরকার এ ধরনের নীতির ওপর বেশি নির্ভর করে না; বিশেষ করে সাহায্যপ্রাপ্ত খাতে যদি কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা না থাকে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্প অনেক দিন ধরে এ ধরনের নীতি–সহায়তা পেয়ে আসছে। কিন্তু ছয় বছর ধরে কর্মসংস্থানে স্থবিরতা সত্ত্বেও কেন এই সহায়তা আরও বাড়াতে হবে, সেটা বোধগম্য নয়। তার বদলে আরও কোনো সম্ভাবনাময় খাত আছে কি না, তা দেখে তাদের সহায়তা দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে।

সামষ্টিক নীতিমালার সঙ্গে প্রয়োজন খাতভিত্তিক নীতি, যাতে অগ্রাধিকারের খাতগুলোকে প্রণোদনা ও সহায়তা দেওয়া যায়। বাংলাদেশে এ ধরনের নীতিমালা যে গৃহীত হয়নি, তা নয়; কিন্তু তা সত্ত্বেও পোশাকশিল্প ছাড়া আর কোনো শ্রমনিবিড় শিল্প কেন গড়ে উঠছে না, তা বিশ্লেষণের প্রয়োজন। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া—এসব দেশ ইলেকট্রনিকস, জুতা (শুধু চামড়ার নয়, অন্যান্য জুতাও), আসবাব ইত্যাদি শিল্পের প্রসারের মাধ্যমে একদিকে যেমন লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে রপ্তানিও বহুমুখী করেছে। তিন দশকের বেশি সময় ধরে আমরা কেন একটি শিল্পের ওপর নির্ভরশীল হয়ে রইলাম এবং তাকেই প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছি, তা খতিয়ে দেখার এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় বের করার সময় এখনই।

সামষ্টিক ও খাতভিত্তিক নীতিমালার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন হবে শ্রমবাজারকে লক্ষ্য করে বিশেষ কর্মসূচি। সেখানে থাকতে হবে বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যবস্থা, বাজারমুখী দক্ষতা সৃষ্টির জন্য প্রশিক্ষণ এবং নিয়োগকর্তা ও চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে চাকরি পেতে সহায়তা করা। এ ধরনের কর্মসূচিগুলোই তরুণদের বিশেষভাবে সাহায্য করতে পারে। সুতরাং তাদের সহায়তা করার লক্ষ্যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কিছু বিশেষ কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা জরুরি।

সরাসরি কর্মসংস্থানের জন্য কী ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা যেত পারে? উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে স্বকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা যুবকদের কাজের জন্য
একটি ভালো হাতিয়ার হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে যে সবার মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষমতা বা ইচ্ছা থাকে না (যদিও কেউ কেউ মনে করেন যে সবার মধ্যেই উদ্যোক্তা হওয়ার মতো গুণ সুপ্ত থাকে)। তা ছাড়া, উদ্যোক্তা হতে গিয়েও অনেক সময় বাধার সম্মুখীন হতে হয়। যে কর্মসূচিই গ্রহণ করা হোক না কেন, এসব বিষয় মনে রাখতে হবে এবং তরুণেরা যেন বাধাগুলো পেরিয়ে নিজেদের (এবং অন্যের) জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে।

যারা উদ্যোক্তা হতে চায় না এবং বেতনভিত্তিক চাকরি চায়, তাদের জন্য সাময়িকভাবে গণপূর্ত কর্মসূচির আদলে বিশেষ কর্মসূচির কথা ভাবা যেতে পারে। তবে কী ধরনের কাজ তাদের শিক্ষার স্তর ও অন্যান্য যোগ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, সেসব বিবেচনা করেই এ ধরনের কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, সরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রতিষ্ঠানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত, সামাজিক সেবামূলক কাজ (যেমন বয়স্কদের সেবা ও দেখাশোনা, শিশুদের দেখাশোনা ইত্যাদি) অন্তর্ভুক্ত করে এ ধরনের কর্মসূচি প্রণয়ন করা যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে এ ধরনের কাজে ন্যূনতম মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ কর্মসূচির কথা ভাবা যেতে পারে এবং অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে চাকরিপ্রার্থী ও নিয়োগকর্তাদের মুখোমুখি করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানো ও যথাযথ কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে বেশ কিছু কাজ চলছে এবং আলোচনাও হচ্ছে অনেক। তবে সার্বিক বিবেচনায় অবস্থাটি কেমন এবং কর্মসংস্থানের সমস্যা মোকাবিলায় এ ক্ষেত্রে কী করণীয়, সেটা পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

আশা করি, নতুন সরকার তার প্রথম ১০০ দিনের মধ্যেই একটি জাতীয় কর্মসংস্থান রণনীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেবে।

রিজওয়ানুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ