ইংরেজি পাঠ্যবইয়ে নারী ও পুরুষ

আমার স্কুলজীবনে সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ছিল ইংরেজি। তাই আজও স্কুলজীবনে পাঠ্যবইয়ের কথা ভাবলে সবার আগে মনে পড়ে ঝকঝকে ইংরেজি বইয়ের কথা। বইগুলোর প্রায় প্রতিটি রচনাই আজও আমার মনে জ্বলজ্বল করে। শৈশবে পড়েছি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রণীত ইংলিশ ফর টুডে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সেই বইগুলোতে বেশ আনন্দদায়ক বিষয় ছিল। তবে কিছু ব্যাপার প্রায়ই আমার কাছে খটকা লাগত। সম্ভবত আমাদের সময়ে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ‘ইংলিশ ফর টুডে’ বইতে কখনোই কোনো কর্মজীবী গৃহী মাকে খুঁজে পাইনি। মা যেহেতু কর্মজীবী ছিলেন, তাই আমার মনে বিষয়টি বেশ অস্বাভাবিকই ঠেকত। সেই বইগুলোতে কর্মজীবী নারীর একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন স্কুলের শিক্ষিকা। আজও মনে পড়ে, নবম-দশম শ্রেণির বইয়ে পেয়েছিলাম তারেক নামের এক চরিত্র। সে ছিল একাধারে ভালো ছাত্র, ভালো আঁকিয়ে এবং সর্বগুণে গুণান্বিত এক পুরুষ চরিত্র। তারেকের উজ্জ্বল চরিত্রের আভায় তার বন্ধু সামিরা নামের নারী চরিত্রটি ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। প্রায়ই ভাবতাম, সামিরার চরিত্রটি কি আরেকটু বলিষ্ঠ হতে পারত না!

প্রায় দুই দশক হতে চলল স্কুলের পাট চুকিয়েছি। এই দুই দশকে বিভিন্ন আঙিনায় বাংলাদেশের নারীর অর্জন ঈর্ষা করার মতো। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম প্রকাশিত বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদনে নারী-পুরুষের সমতার দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সবার ওপরে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিজ্ঞান, শিল্প-সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে হাজারো বাধা ও কাঁটা পায়ে ঠেলে বাংলাদেশি নারীর অগ্রযাত্রা আজ আর গল্প নয়, সত্যি। কিন্তু বাংলাদেশের নারীদের এই অর্জন, এই অবস্থান কি সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে?

সম্প্রতি শিশুদের হাতে এসেছে নতুন বছরের নতুন পাঠ্যপুস্তক। আমার আগ্রহের জন্য প্রথমেই হাতে তুলে নিয়েছিলাম জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি পাঠ্যবইগুলো। বইগুলোর প্রথম প্রকাশ ২০১২ সালে এবং ২০১৪ সালে এক দফা পরিমার্জন বা সংশোধন করা হয়েছে। ২০১৮ সালে বইগুলো পুনঃমুদ্রিত হয়েছে।
আশার কথা, বইগুলোর বিষয়বস্তু, অলংকরণ ও সংলাপে নানাভাবে ছেলেমেয়ের সম-অংশগ্রহণকে মোটামুটি দৃশ্যমান করা গেছে। ছেলে ও মেয়ে শিশু একসঙ্গে খেলছে, পড়ছে, স্কুলে যাচ্ছে, সংলাপে অংশ নিচ্ছে। কন্যাশিশুর সুষম খাদ্য গ্রহণ ও ভালো চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি ছবি ও সংলাপের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ ছাড়া সংখ্যালঘু এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বিভিন্ন চরিত্রের আনাগোনার মধ্য দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। এসেছে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী চরিত্র। তবে এই অন্তর্ভুক্তি কতটা বিশ্বাসের জায়গা থেকে আর কতটা পরিস্থিতির প্রয়োজনে, সে প্রশ্ন রয়েই যায়। তাই বইয়ের ভাষায় চরিত্রগুলো দৃশ্যমান হলেও শিশুদের মনের ওপর তারা তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না।

প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি বইগুলোতে আজও বারবার শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন নারী। পুরো প্রাথমিক শিক্ষার যাত্রায় ইংরেজি বইয়ে শিশুরা মাত্র দুবার পুরুষ শিক্ষকের দেখা পেয়েছে। পাঠ্যবইয়ে নারীর পেশা নির্বাচনের বেলায় সমাজের চিরাচরিত ধ্যান-ধারণা থেকে হয়তো নিজেরাই বেরিয়ে আসতে পারেননি এর রচয়িতা! দ্বিতীয় শ্রেণিতে শিশুরা নারী শিক্ষক আনিতা সরকারের দেখা পেয়েছেন যিনি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস নেন। বর্ণনা ও ছবিতে স্পষ্ট করা হয়েছে তাঁর সংসার ও পেশাগত দায়িত্বের মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়টি। অন্যদিকে তৃতীয় শ্রেণির ৫ নম্বর পৃষ্ঠায় মাহবুব আলম আবির্ভূত হয়েছেন ইংরেজির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে। পুরুষ পেশাজীবীর গৃহস্থালির কাজে জড়িত হওয়ার বিষয়টি যথারীতি উপেক্ষিত। তৃতীয় শ্রেণিতে কয়েকটি চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারীর ছবি আনা হয়েছে বটে তবে নারীর এই রূপ যেন ছবিতেই আটকে গেছে, তার বাইরে যায়নি। চতুর্থ শ্রেণিতে চিকিৎসা পেশায় মাত্র একজন মাকেই খুঁজে পেয়েছে শিশুরা। তৃতীয় শ্রেণিতে একজন নারীর ছবি পাইলট হিসেবে এলেও চতুর্থ শ্রেণিতে বাবার ভূমিকায় একজন পুরুষই পাইলট হিসেবে বাস্তব হয়ে উঠেছেন শিশুদের সামনে।

অন্যদিকে অর্থ ব্যবস্থাপনায় নারীর অংশগ্রহণ মোটেই দৃশ্যমান হয়নি। দোকানদার আর ব্যাংকার চরিত্রের ছবিতে এবং বর্ণনায় ঘুরেফিরে বারবার এসেছে পুরুষ। স্বস্তির বিষয়, ছেলে ও মেয়ে শিশু উভয়েরই গৃহকর্মে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা হয়েছে; কিন্তু এখানেও ধরা পড়েছে বৈষম্য। তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের মেয়ে শিশুটিকে তার মায়ের পক্ষ থেকে দেোয়া হয়েছে চারটি নিদের্শনা; যেখানে ময়লা ডিম পরিষ্কার করার মতো কাজও অন্তর্ভুক্ত ছিল। অন্যদিকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে আজিম নামের ছেলেটির হাতে তার মা শুধু থালাবাসন রান্নাঘরে পাঠিয়েই সন্তুষ্ট থেকেছেন। পঞ্চম শ্রেণিতে ব্যাংকার বাবার বিপরীতে শিশুরা খুঁজে পেয়েছে গৃহিণী মাকে। আবার সেই ব্যাংকার বাবা অবসরে গান শোনেন এবং গল্প লেখেন। অন্যদিকে মা অবসরে শুধুই সেলাই করেন। মা রান্না করেন, শিশুরা মাকে সাহায্য করে, কিন্তু বাবা যথারীতি রান্নার প্রশংসা করেন আর খাবার উপভোগ করেন। পঞ্চম শ্রেণির বইয়ে ব্যাডমিন্টন, সাঁতার এবং ফুটবলে নারী ক্রীড়াবিদের ছবি অন্তর্ভুক্ত হলেও কাবাডি, সাইক্লিং, ভলিবলসহ অধিকাংশ খেলার প্রতিনিধিত্ব করছেন পুরুষ।
বিভিন্ন এলাকার খ্যাতনামা ব্যক্তির ভিড়ে শিশুরা খুঁজে পায়নি কোনো কীর্তিমান নারী ব্যক্তিত্ব। চতুর্থ শ্রেণিতে শিশুরা পেয়েছে এস এম সুলতানকে আর পঞ্চম শ্রেণিতে কিশোরগঞ্জের আলোকিত সন্তান হিসেবে শিশুরা জেনেছে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, জয়নুল আবেদিন কিংবা সৈয়দ নজরুল ইসলামের কথা। এ ছাড়া শিশুরা খুঁজে পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, পেয়েছে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতীর কথা একবার বলা হলেও ছবিহীন চন্দ্রাবতীর উপস্থিতি শিশুমনে কোনো প্রভাব ফেলার কথা নয়।

একটি বিষয় উল্লেখ্য, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বইগুলোর রচয়িতা নির্বাচনে জেন্ডার সমতা থাকলেও চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই রচনার দায়িত্বে ছিলেন মাত্র একজন নারী। সব বইয়ের অলংকরণ করেছেন গুণী শিল্পী হাশেম খান। পরিশেষে বলব, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের শিশুদের সামনে জেন্ডার সমতা দৃশ্যমান করার এই প্রচেষ্টা নিশ্চিতভাবেই প্রশংসার দাবিদার। তবে এই যাত্রায় জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠার অন্তর্নিহিত অর্থ উপলব্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। নতুবা বিষয়টি শুধু পাঠ্যবইয়ের পাতাতেই সজ্জিত হবে; শিশুর মনোজগতে তা তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক