গণতন্ত্রের মেরামতি

গত বছরের সবচেয়ে চমকপ্রদ উচ্চারণটি কোনো রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন অথবা সুশীল সমাজ করেনি, করেছে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা। নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে তারা সেটি কাগজে লিখে সবার চোখের সামনে তুলে ধরেছে ‘রাষ্ট্রের মেরামত চলছে’।

সড়কের অরাজকতাকে যখন রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক নানা ভঙ্গুরতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখে শুধু সড়ক ব্যবস্থাপনার নয়, রাষ্ট্রের মেরামতিতে লাগতে চেয়েছে এই তরুণ শিক্ষার্থীরা, তখন বুঝতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে ঘুণ ধরেছে, তা তাদের অপাপবিদ্ধ চোখেও ধরা পড়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে অবশ্য পানি অনেক ঘোলা হলো, তাদের অনেক আশ্বাস দেওয়া হলো, মাথায় হেলমেট পরা কিছু যুবক হামলে পড়ল। কিন্তু এই পাঁচ মাসেও বেহাল ব্যবস্থাপনার সড়কগুলোর হাল আর ফিরল না। সড়কে নিয়মিত প্রাণ ঝরছে। ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক বাতিগুলো চব্বিশ ঘণ্টা লাল-কমলা-সবুজ হচ্ছে, একটা চলমান কৌতুক নাটকের মতো।

তবে রাষ্ট্র তো আর এক সড়ক বিভাগে সীমাবদ্ধ নয়। এর অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, সবগুলোতেই মেরামতি প্রয়োজন। প্রশাসন বাইরে ফিটফাট, কিন্তু ভেতরে? প্রশাসন কি স্বচ্ছ, জনবান্ধব, কার্যকর? আদালতপাড়ায় বিচারের বাণী কি নিভৃতে কেঁদে যায়, নাকি উচ্ছ্বাস নিয়ে ধ্বনিত হয়? গরিব মানুষ বিচার পায়? বিত্ত আর ক্ষমতাশালী অপরাধীদের হাতে হাতকড়া পড়ে? শিক্ষাব্যবস্থা কি আলো ছড়ায়? স্বাস্থ্য খাত কি নিজেই স্বাস্থ্যবান? ব্যাংক লুটে খাওয়া, দুর্নীতিতে, মাদক ব্যবসায়ে বিলিয়নপতি হওয়াদের কি রাহুর গ্রাস চলছে? নাকি তাঁদের বৃহস্পতি ঊর্ধ্বমুখী?

গত ১০ বছরে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এই উন্নয়ন প্রত্যাশা বাড়িয়েছে। প্রত্যাশা এখন সুশাসন, সুবিচারের জন্য। সব প্রতিষ্ঠানের মেরামতির জন্য। যেকোনো তরুণকে জিজ্ঞেস করলে সে মেরামতির দশটা জায়গা দেখিয়ে দেবে। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের এক সন্তান আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংকল্প মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল, সেগুলো কেন আমাদের চেতনার আশপাশ দিয়েই শুধু ঘুরে বেড়ায়, কেন্দ্রে স্থান নিতে পারে না? অনেক তরুণ সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন রেখেছে, কেন তারা তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে পারল না? এবার যে নির্বাচন হলো, তাতে সব দলের অংশগ্রহণ ছিল; কিন্তু তা কি স্বচ্ছ ছিল? নির্বাচন নিয়ে পত্রপত্রিকায়, চায়ের দোকানের আড্ডায়, আলোচনায় মানুষের অসন্তুষ্টি শোনা গেছে। নির্বাচনের নানা অনিয়মের জন্য মহাজোট ঐক্যফ্রন্টকে দুষেছে। ঐক্যফ্রন্টের অবশ্যই দায় ছিল, তারা সমাবেশ ঘটাতে পারেনি, একটা দায়সারা ভাবও ছিল তাদের কর্মকাণ্ডে। কিন্তু শুরু থেকেই তাদের জন্য নির্বাচনী মাঠটা যে সমান ছিল না, তার দায়টা কে নেবে?

প্রশ্ন অনেক, উত্তরগুলো পেতে হবে। উত্তরগুলো তরুণেরা চায়। আমার বিশ্বাস, তারা পাবেও, কারণ তারা এখন অনেক প্রত্যয়ী। স্কুলের শিশুরা যখন খোদ রাষ্ট্রের মেরামতি হাতে নেয়, এক প্রজন্মে এটি তারা অনেকটাই করতে পারবে। নতুন একটি সরকার এখন ক্ষমতায়। আগামী পাঁচ বছর যদি এই সরকার তরুণদের মেরামতির কাজটাতে হাত দিয়ে এগিয়ে নেয়, তাহলে আগামী নির্বাচনে এবারের অনিয়ম-অসন্তুষ্টিগুলোর পুনরাবৃত্তি হবে না। উন্নয়ন হবে, গণতন্ত্রও মজবুত হবে। এবং এর ফলে সাম্য প্রতিষ্ঠা না হোক, বৈষম্য কমবে, মানবিক মর্যাদা আর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি হবে। এই সরকারের মন্ত্রিসভায় নবীনদের প্রাধান্য। এই নবীনেরা যদি দেশের তরুণদের আস্থা অর্জন করতে পারেন, তাহলে মেরামতির কাজটা সহজ হবে। আর যদি সরকার চলে চিরাচরিত পথে, তাহলে অর্থনীতি হয়তো এগোবে, কিন্তু রাষ্ট্রের ভিত্তিতে ঘুণটা ব্যাপক হবে। তরুণেরা হতাশ হবে, বিক্ষুব্ধ হবে।

রাষ্ট্রের ভিত্তিটা গড়ে দেয় গণতন্ত্র। সবার আগে গণতন্ত্রের মেরামতিটাই প্রয়োজন। নতুন সরকার কাজটি হাতে নিলে মানুষ সাড়া দেবে, দলগুলো সাড়া দেবে, তরুণেরা হাত মেলাবে। আমি নিশ্চিত এই মেরামতিকাজে বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন সদিচ্ছা এবং শতভাগ নিষ্ঠার।

আমি তরুণদের প্রত্যাশাগুলোর কথাই বলি। তারা চায় দেশে সব দলের জন্য মাঠ সমান হোক। যারা মুক্তিযুদ্ধ মানেনি, মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত অবস্থানে ছিল, তাদের বাদ দিয়ে বাকিদের প্রাপ্য জায়গা দিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি কিছু বাম সংগঠনের ছাত্রছাত্রীদের দেখেছি। হামলা-মামলা সয়ে তারা সুন্দর কিছু আদর্শকে এখনো জীবন্ত রেখেছে। আমাদের দেশটা যাঁরা গড়েছেন, গড়ে যাচ্ছেন, সেই কৃষক-শ্রমিকদের জন্য তারা মাঠে নামে, এদের জায়গাটা নিশ্চিত হলে গণতন্ত্র মজবুত হবে, তাতে আদর্শচিন্তা ফিরে আসবে।

জাতীয় সংসদ গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য, এটি সচল হোক। সেখানে দল নয়, দেশ নিয়ে কথা হোক। সংসদীয় কমিটিগুলো সরকারের কাজে সত্যিকার নজরদারি করুক। সরকার আর দলের প্রভেদ সুনির্দিষ্ট এবং অলঙ্ঘনীয় হোক, প্রশাসন ও পুলিশ মানুষের পক্ষে কাজ করুক, আদালতের বিচারকেরা আস্থা রাখুন মানবতায়, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাক।

তরুণদের দাবি সুশাসন, সেবাপ্রাপ্তি, স্বচ্ছতা, জবাবদিহির চর্চা। শিক্ষা এখন ব্যয়বহুল কোচিং-বাণিজ্য আর গাইড বই প্রকাশকদের দখলে। একটা চমৎকার শিক্ষানীতি আছে বটে, কিন্তু তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আলমারিতে রাখা আছে। তাতে ধুলা জমছে। এর অবসান হোক। স্বাস্থ্য খাতে গরিবের প্রবেশাধিকার সীমিত, ভালো চিকিৎসা পেতে হলে টাকা ঢালতে হয়। তরুণেরা এসবের সমাপ্তি চায়। তরুণেরা মতপ্রকাশের, মুক্তচিন্তার অধিকার চায়।

এই অধিকার খর্ব হলে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে শূন্য সহনশীলতা ঘোষণা করেছে নির্বাচনী ইশতেহারে, তা কার্যকর হবে না। স্বচ্ছ সমাজে দুর্নীতি আশকারা পায় না, কারণ সবাই সে সম্পর্কে জানতে পারে, আইনপ্রয়োগকারীরাও। প্রশাসন স্বচ্ছ হলে দুর্নীতি কমে। স্বচ্ছতার জন্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অপরিহার্য। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিলুপ্ত হোক, প্রয়োজনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে সাইবার দুর্বৃত্তদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য ভিন্ন আইন হোক। কিন্তু ডিজিটাল যুগে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের কাজে অ্যানালগ যুগের বাধা দূর হোক। তরুণদের জন্য তাদের কথা বলার পরিসরটা বড় হোক, উন্মুক্ত হোক।

গণতন্ত্র মানে সহনশীলতা। সহনশীলতার চর্চা সরকারি দলের কথাবার্তা ও কাজে থাকতে হবে। আমরা প্রশংসার ওপর এত বেশি নির্ভরশীল যে সত্যিকার সমালোচনাকেও নিন্দা ভাবি। এই অভ্যাস থেকে বেরোতে হবে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান বিতর্ক সংগঠনটির দায়িত্বে ছিলাম দুই দশকের মতো। আমি দেখেছি কত কঠিন কঠিন বিষয়ে বিতর্ক হয়েছে, পক্ষে-বিপক্ষে অসংখ্য মত এসেছে। দিনের শেষে যাদের যুক্তি ক্ষুরধার, তারা জিতেছে। অথচ আমরা বিতর্ক করি না, কুতর্ক করি। গালিগালাজ করি। কোনো দলের সমালোচনা করে কেউ কিছু লিখলে ভিন্ন দলের অনুসারীরা তাঁকে গালি দেয়। যেখানে স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ রুদ্ধ হয়, সেখানে ক্ষোভ তৈরি হয়, ক্ষোভ থেকে গালিও তৈরি হয়। তরুণদের কাছে এ অবস্থা কাম্য হতে পারে না। এটা সরকারকে মনে রাখতে হবে।

এই সরকারের আমলেই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস উদ্‌যাপিত হবে: স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শতবার্ষিকী। সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা কি মুক্তকণ্ঠে বলতে পারব, দেশটা সাম্য, ন্যায়বিচার আর মানবিক মর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠার পথে আছে? বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে যে স্বচ্ছ রাজনীতির কথা বলেছেন, তা বাস্তবায়িত হচ্ছে, গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটছে এবং শিক্ষার আদর্শগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে?

এসব প্রশ্নের উত্তর ‘না’ হলে বুঝতে হবে আমরা ঘুণে ধরা কোনো স্থাপনাই মেরামত করতে ইচ্ছুক নই। তাই সরকারকে এখনই কাজে নামতে হবে। গণতন্ত্রের মেরামতি একটি সমবায়ী কাজ, তরুণেরা তৈরি। রাষ্ট্র ও সরকার উদ্যোগী হলে জনসাধারণও শরিক হবে। এর বিকল্প নেই।

নতুন বছরের সামনের দিনগুলো যেন অবারিত আর ঝকঝকে হয়। তরুণেরা, সব বয়সের নাগরিকেরা, তা-ই চায়। এটা অনুধাবন করে সরকারকে গণতন্ত্রের মেরামতির কাজে হাত দিতে হবে।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ