সুবর্ণচরে গণধর্ষণ

নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাতে এক নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তথ্য অনুসন্ধান কমিটির দেওয়া প্রাথমিক রিপোর্টের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সুবর্ণচরের ঘটনাটি সারা বিশ্বের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ইতিমধ্যে অনুসন্ধান করেই রিপোর্ট করেছে যে ভোটদান নিয়ে ভুক্তভোগীর সঙ্গে ভোটকেন্দ্রে বচসা হয় এবং ফল ঘোষণার রাতেই তিনি ধর্ষণের শিকার হন। পুলিশ প্রশাসনও গুরুত্বের সঙ্গে এজাহারভুক্ত ৬ জন এবং তদন্ত করে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আরও ৭ জনকে আটক করেছে। এর মধ্যে ৭ জন আসামি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।   

তাই এটা অনেকটা প্রতিষ্ঠিত ধারণা যে গ্রেপ্তার হওয়া দুর্বৃত্তরা ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে ওই অপকর্ম করে থাকতে পারে। কমিশন বলছে প্রতিবেদনটি প্রাথমিক। সে কারণে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের মুখে তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই ‘প্রমাণ’ না পাওয়ার দাবি করা সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করাটা কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত হয়েছে, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। আগ বাড়িয়ে তাঁর সনদ দেওয়া পক্ষপাতদুষ্ট বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। কেউ হয়তো যুক্তি দেখাবেন যে, চূড়ান্ত প্রতিবেদনে একই ফলাফল আসতে পারে। তবে সেটি তো আমাদের ‘স্বাধীন’ মানবাধিকার কমিশনটি দাবি করলে হবে না; তাদের যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে সেটি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

আমরা আশা করব, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আর দশটি ঘটনার মতো এর তদন্তকাজও ঝুলিয়ে রাখবে না। যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে তারা এ বিষয়ে  চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে। জনগণ তাদের প্রতিবেদন পড়ে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর পাবে বলে আশা করে। সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সুবর্ণচরের ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও প্রশাসন লজ্জিত। সাবেক ইউপি সদস্য, যাঁর ভোট করা না-করা নিয়ে ভুক্তভোগীর ‘পূর্বশত্রুতা’ ছিল, তাঁকে আওয়ামী লীগ থেকে দ্রুত বহিষ্কার সেটাই প্রমাণ করে। সংবাদমাধ্যমের খবর এটাও নিশ্চিত করেছে যে ভোট দেওয়া নিয়ে ভুক্তভোগী ও আসামিদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। আর মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পূর্বশত্রুতার সনদ দিয়ে দিলেন।

এর আগেও আমরা দেখেছি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আক্রান্ত মানুষের অধিকার রক্ষা বা প্রতিকারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ যেগুলো সরকারের জন্য সংবেদনশীল ও বিব্রতকর, সে বিষয়গুলোতে তাদের রিপোর্ট কদাচিৎ আলোর মুখ দেখে। আগের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান মানবাধিকার রক্ষায় কিছু করতে না পারলেও আওয়াজ দিতেন। এখন সেই আওয়াজও রহিত হয়ে গেছে। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিস্তর ঘটনা ঘটলেও কমিশন নীরব থাকাকেই শ্রেয় মনে করেছে। মানবাধিকার কমিশন আক্রান্ত মানুষের অধিকার রক্ষায় কাজ করে, এটা এখন পর্যন্ত তারা দৃশ্যমান করতে পারেনি।

নোয়াখালীর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই নারী ভূমিহীনদের নেত্রী। অধিকারহারা মানুষের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণেই তাঁকে নিগৃহীত হতে হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই নারী ১৩ জানুয়ারিও প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনি তাঁর পছন্দের প্রতীকে (ধানের শীষ) ভোট দেওয়ায় ওরা হুমকি দিয়ে বলেছিল, ‘বিকেলে তোর খবর আছে।’ আমরা মানবাধিকার কমিশনের কাছে জানতে চাইব, পূর্বশত্রুতা পুরোনো, ভোটের রাতে কেন তার শোধ নেওয়া হলো। আর অপরাধীরা যে অহরহ ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করে, সে কথাও কারও অজানা নয়।

তদন্তকালে ভুক্তভোগীর সঙ্গে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কি কথা বলেছিলেন? না বলে থাকলে কীভাবে তিনি পূর্বশত্রুতার ‘রায়’ দিয়ে দিলেন?