আইন হাতে তুলে নেওয়া না-নেওয়া

নির্বাচনের ঢোল ছাড়া যখন কোনো আওয়াজের পাত্তা ছিল না, তখন ঢাকার কাছেই সোনারগাঁ উপজেলায় প্রকাশ্য সড়কে একজন জনপ্রতিনিধি আইন তাঁর নিজের হাতে তুলে নেন। বিজয় দিবসের আগের দিন ১৫ ডিসেম্বর (শনিবার) নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁ) আসনের প্রার্থী লিয়াকত হোসেন খোকার পক্ষে গণসংযোগ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন সোনারগাঁ পৌরসভার মেয়র এবং বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির (বিসিডিএস) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদেকুর রহমান সাদেক। এ সময় সোনারগাঁ জাদুঘরের সামনে বিপরীত দিক থেকে আসা বাঁশবোঝাই নছিমনের সঙ্গে তাঁর গাড়ির ধাক্কা লাগে। এতে মেয়রের গাড়ির এক পাশের সামান্য রং চটে যায়। ক্ষিপ্ত মেয়র সাদেকুর রহমান গাড়ি থেকে নেমে হাতের লাঠি ও পায়ের লাথি দিয়ে নছিমনচালক প্রতিবন্ধী কিশোর জামাল হোসেন ও তাঁর ভাগিনা তামিমকে বেধড়ক পেটাতে থাকেন। পা ধরে ক্ষমা চেয়েও জামাল–তামিম রক্ষা পাননি। পরে মেয়রের সমর্থকেরাও তাঁদের মারধর করে গাড়িসহ আটকে রাখেন। ঘটনার পর তাঁদের সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।

এসব ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে চারদিকে শুরু হয় নিন্দার ঝড়। মেয়রের শাস্তির দাবি ওঠে। আবার অনেকে সহজ–সরল মেয়র কতিপয় দুষ্টু বালককে মৃদু শাসন করাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে ষড়যন্ত্রকারীদের কালো হাত গুঁড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান। অসাধারণ আন্তর্জাতিক মানের সাধারণ নির্বাচনের তখনো ম্যালা বাকি। এই পরিস্থিতিতে কোনো ষড়যন্ত্রকেই দানাপানি দেওয়া ঠিক হবে না। তাই প্রথম রাতেই বিড়াল মারনেওয়ালাদের হুঁশিয়ারি আসে। এক দিন পর ১৭ তারিখ সোমবার রাতে ‘ওপরের নির্দেশে’ মেয়র সাদেকুর রহমানকে ডিবির লোকজন তাঁদের অফিসে ডেকে নিয়ে যান। মানুষ জানল আইন তার নিজের পথে হাঁটছে, অপরাধীর কোনো ক্ষমা নেই।

কিন্তু আইন যে হাতির মতো। ছেড়ে দিলে সে তার চেনা পথেই চলে, ঠিক–বেঠিকের ধার ধারে না, সেটা মানুষ আবার জানতে পারে পরদিন। পরদিন মঙ্গলবার দুপুরে মেয়র সাদেককে ছেড়ে দেয় জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এলান করে দেওয়া হয়, যাঁকে মারধর করা হয়েছিল, তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা কিংবা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার অভিযোগ না পাওয়ায় মুচলেকা নিয়ে সাদেকুর রহমানকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছিল। মেয়র সাদেকুর রহমান জানান, নছিমনচালক ও তাঁর ভাগিনাকে মারধরের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে তাঁদের কাছে মাফ চেয়েছেন তিনি। তবে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আইনের হেফাজতকারীরা কেন কোনো মামলা করেননি, সে প্রশ্ন করা এ ক্ষেত্রে বেয়াদবির শামিল। কাজেই নিজ নিজ চরকার হেফাজত করাই মঙ্গল।

বাঙালিদের নাকি আইন হাতে তুলে নেওয়ার একটা জাতিগত ঝোঁক আছে। এ ব্যাপারে শিক্ষিত–অশিক্ষিতে কোনো ভেদ আছে বলে মনে হয় না। দাদাগিরি গুন্ডাগিরি নাকি এখানকার মজ্জাগত খাসলত এবং খুবই সংক্রামক ফেসবুকে এক রকমই বয়ান দিয়েছেন দক্ষিণ ভারতের এক বিদুষী অধ্যাপিকা। দক্ষিণ ভারতের একজন আইসিএস কর্মকর্তা পশ্চিম বাংলার আলিপুরদুয়ার জেলার জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় সম্প্রতি থানায় ডেকে নিয়ে এসে এক তরুণকে নিজ হাতে শিক্ষা দেন। তাঁকে পেটানোর দৃশ্য ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে আমজনতা নিন্দায় মেতে ওঠে। এর সূত্র ধরে অধ্যাপিকা বলেন, ওটা মাটির দোষ। জেলা প্রশাসক নিখিল নির্মল ভালো ছেলে, মেধাবী ছেলে, দশসেরা কর্মকর্তাদের একজন। পশ্চিম বাংলায় যাওয়ার পরে ওখানকার রাজনৈতিক কালচার তাঁর ওপর ভর করেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতার মারদাঙ্গা চোটপাটের ফিরিস্তি টেনেছেন। সত্য হোক মিথ্যা হোক, তিনি উদাহরণ দিয়েছেন একের পর এক। ভাগ্যিস তিনি জানতেন না আমাদের মন্ত্রীদের ক্যামেরার সামনেই রেলের পেয়াদার গায়ে হাত তোলার কথা কিংবা চালকের জামার কলার ধরে টানাটানির কথা অথবা পরীক্ষার হলে ঢুকে নবীন ম্যাজিস্ট্রেটের পরীক্ষার্থী পেটানোর খবর। কিংবা টক শো থামিয়ে সাথি বক্তার চোখ তুলে নিতে এগিয়ে যাওয়ার ঘটনা।

আইন হাতে তুলে নেওয়ার ঝোঁকটা হয়তো দুই বাংলায় আছে কিন্তু একটা গুণগত তফাতও আছে। মমতার বাংলায় পুলিশ নিজের উদ্যোগে জেলা প্রশাসক নিখিল নির্মলের কাণ্ড নিয়ে মামলায় দায়ের করেছে। আইসিএসদের অ্যাসোসিয়েশন নিখিলের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। তদন্তের অনুমতি মিলেছে। জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে অন্য একজনকে পাঠানো হয়েছে। এখন থেকে কোনো জেলার প্রশাসনের সঙ্গে নিখিল আর যুক্ত থাকবেন না। তাঁর স্ত্রীকেও মারধরে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হবে। আলিপুরদুয়ারের এক পুলিশ কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, যাঁরা ঘটনার দিন থানায় উপস্থিত ছিলেন, প্রথমে তাঁদের জেরা করা হবে। এর মধ্যে যেমন জেলা শাসকের স্ত্রীর সঙ্গীরা রয়েছেন, তেমনি পুলিশও আছে। তারপর মূল ব্যক্তিদের বয়ান নেওয়া হবে।

ন্যূনতম গণতন্ত্র আর ন্যায্য বিচারব্যবস্থার এই এক ক্ষমতা, ঢাকঢাক গুড়গুড় থাকলেও জবাবদিহি একেবারেই অদৃশ্য থাকে না। দিনে–অদিনে তার দেখা মেলে। রাজনৈতিক হালচাল সবকিছু বানচাল করতে পারে না। নিশ্চয় আমরাও এক দিন বিচার পাব, জানতে পারব জামাল হোসেন কেমন আছেন এবং তিনি মেয়রকে মাফ করেছেন কি না। একদিন আমরা এও জানতে পারব, সাভারে যে দায়িত্ববান ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রহার করা হয়েছে, তাঁর নির্যাতনেরও প্রতিকার হলো কি না। নিশ্চয় একদিন।

গওহার নঈম ওয়ারা: শিক্ষক ও গবেষক।