অভিযানের পর আত্মসমর্পণ?

আট মাস ধরে মাদকবিরোধী কঠোর অভিযান চললেও সরকারের নীতিনির্ধারকদের কেউ দাবি করতে পারবেন না যে মাদকের কেনাবেচা বা সরবরাহ বন্ধ আছে। সরকারি সূত্রে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এটা প্রমাণিত যে সরকারের মাদকবিরোধী অভিযান এবং মাদকের চোরাচালান ও ব্যবসা দুটোই সমান গতিতে চলছে। এটি শুধু অস্বাভাবিক নয়, উদ্বেগজনকও।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত রোববার কক্সবাজারের টেকনাফের সাবরাং থেকে ১ লাখ ২০ হাজার ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। আগের দিনও উদ্ধার হয়েছে ৪০ হাজার ইয়াবা বড়ি। গত মাসে এবং চলতি জানুয়ারি মাসের ১৩ দিনে টেকনাফ থেকে বিজিবি, র‍্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর উদ্ধার করেছে ১৪ লাখ ইয়াবা বড়ি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদক আটকের যেসব তথ্য দিয়েছে, তা আমাদের মোটেই স্বস্তি দেয় না। যে পরিমাণ মাদক আটক হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকছে এবং বিক্রিও হচ্ছে।

মাদক, বিশেষ করে মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবায় আসক্ত হয়ে লাখ লাখ মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে। কোনো পরিবারের একজন মাদকাসক্ত হলে পুরো পরিবারটির ওপরই তার ভয়াবহ অভিঘাত পড়ে; অনেকের পক্ষে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ মাদকের ছোবলে আক্রান্ত হলেও প্রতিকারে সরকার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। গত বছর মে মাসে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানে তিন শতাধিক মানুষ নিহত হলেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে বলে যাবে না। ছোট মাদক ব্যবসায়ী ও বহনকারী পাকড়াও হলেও বড় ব্যবসায়ী, তথা মাদকের গডফাদাররা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

আট মাস ধরে মাদকবিরোধী কঠোর অভিযানের পর এখন সরকার মাদক ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবছে বলে পত্রিকার খবরে প্রকাশ। এর মাধ্যমে সরকার প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছে চলমান অভিযানটি সফল হয়নি। অভিযান সফল হলে তো সব মাদক ব্যবসায়ী আইনের আওতায় আসার কথা। সরকারের নতুন চিন্তাভাবনা আমাদের আরও উদ্বিগ্ন করে এ কারণে যে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই এমন এক ব্যক্তি মাদক ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ করতে বলেছেন, খোদ যাঁর বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার গুরুতর অভিযোগ আছে। কেবল তিনি নন, তাঁর পরিবারের অনেক সদস্যের বিরুদ্ধেই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ আছে। কেউ কেউ বিদেশে পলাতক। তাহলে কি তাদের আইনি সুরক্ষা দেওয়ার জন্যই আত্মসমর্পণের কথা বলা হচ্ছে?

প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবানদের সহায়তা ছাড়া মাদক ব্যবসা টিকে থাকার কথা নয়। এই চক্রের সঙ্গে যেমন রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের যুক্ততা আছে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যের যুক্ততার অভিযোগও আছে। ফলে মাদকের বিরুদ্ধে কার্যকর কিছু করতে হলে এই দুষ্টচক্রকে মোকাবিলা করতে হবে। কাজটি সহজ নয়, কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

ইয়াবা বাংলাদেশে তৈরি হয় না। প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে চোরাচালান হয়ে আসে। আমাদের স্থল ও সমুদ্রসীমায় শক্তিশালী সীমান্ত বাহিনী আছে। চোরাচালানিদের ধরার জন্য তাদের কাছে আধুনিক সরঞ্জামও আছে। এরপরও কেন সীমান্ত দিয়ে মাদক আসা বন্ধ করা যাবে না? মিয়ানমার দেশটির যে রাজনৈতিক বাস্তবতা, তাতে তাদের কাছ থেকে কতটুকু সহায়তা পাওয়া যাবে, তা নিয়ে সংশয় খুবই স্বাভাবিক। বাংলাদেশকে এ ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্সের নীতি নিতে হবে। সীমান্তপথে কোনোভাবেই যাতে মাদক প্রবেশ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

সীমান্তের দরজায় ফাঁকফোকর ও দেশের প্রভাবশালী চক্র ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলে মাদকবিরোধী কোনো অভিযানই সুফল দেবে না।