পাখি ধরে চোখ ফুটো করা

কবি বিনয় মজুমদারের ভাষায়, ‘মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়!’ কেন উড়ে যায়? কেন তারা পালিয়ে যায়? সে উত্তরও তিনি দিয়েছেন, ‘বিপন্ন মরাল ওড়ে, অবিরাম পলায়ন করে/ যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নিচে/ রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ।’ নিজেদের ‘শাদা পালকের নিচে’ থাকা এই ‘উষ্ণ মাংস’ শীতের পাখিদের বিপন্ন করে তুলেছে অনেক আগেই। মাংসের লোভেই মানুষ নির্বিচার এই মেহমানদের নিধন করে আসছে। তাই মানুষকে তাদের এত ভয়।

একটা সময় ছিল যখন মানুষ পাখি শিকার করত স্রেফ উদরপূর্তির প্রয়োজনে। হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে উড়ে আসা অতিথিদের হত্যা করত নিতান্ত পেটের পীড়নে। সেই অনিবার্য প্রয়োজনীয়তার শিকারের হয়তো নৈতিক ন্যায্যতা আছে। কিন্তু পাখির মাংসের স্বাদ নিয়ে নেহাত আয়েশি ‘রসনাবিলাস’ চরিতার্থ করা এবং এর মধ্য দিয়ে বিত্তবানের আভিজাত্য প্রদর্শন করাই যদি শিকারের চূড়ান্ত মোক্ষ হয়, তাহলে তা স্পষ্টতই অন্যায়। দেশের প্রচলিত আইনেও (১৯৭৪ সালের সংশোধিত বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন) তা দণ্ডযোগ্য অপরাধ। পরিযায়ী পাখি শিকারের অপরাধে কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। সেই আইন প্রায়ই মানা হয় না। উপরন্তু এসব পাখি শিকার করার পর থেকে জবাই করার আগ পর্যন্ত যে নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায় তাদের রাখা হয়, তা স্বাভাবিক বিবেকবোধকে ঝাঁকুনি দেবে।

গত সোমবার প্রথম আলোয় ‘চোখ ফুটো করে শামুকখোল কেনাবেচা’ শিরোনামে ছাপা হওয়া সচিত্র প্রতিবেদনে সেই নিষ্ঠুরতার একটি খণ্ডচিত্র দেখা গেছে। সেখান থেকে জানা গেল, সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুরবাজার এলাকায় শামুকখোল পাখি বিক্রি হচ্ছিল। সে পাখির চোখ ফুটো করে দেওয়া। ফাঁদ পেতে ধরার পর পাখি যাতে পালিয়ে যেতে না পারে, কাউকে ঠোকর না মারতে পারে এবং প্রশাসনের কেউ ধরে যাতে পাখিকে অবমুক্ত না করতে পারেন, এ জন্য শিকারিরা প্রথমেই চোখ দুটো ফুটো করে দেন। এই নিষ্ঠুরতা রেওয়াজের মতো প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে।

নিষ্ঠুরতা থেকে পশুপাখিকে রক্ষায় ‘জীবজন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতা আইন’ নামে দেশে ১৯২০ সালের একটি আইন আছে। সেই আইন অনুযায়ী পা দড়ি দিয়ে বেঁধে উল্টো করে হাঁস-মুরগি বহন করাও দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু এটি যে অপরাধ, তা যিনি অপরাধ করছেন, তিনিও জানেন না; আর যাঁরা জানেন, তাঁরাও আইনটি প্রয়োগ করেন না। তবে শীতের পাখি শিকার করা যে আইনের লঙ্ঘন, তা মোটামুটি সবাই জানে। যাঁরা পাখি ধরার পর চোখ ফুটো করে দেন, তাঁরা একসঙ্গে দুটি অপরাধ করছেন। প্রথমত, নিষিদ্ধ থাকার পরও শিকার করছেন এবং শিকার করা পাখিকে যন্ত্রণা দিয়ে ‘জীবজন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতা আইন’ লঙ্ঘন করছেন। তাঁদের থামানো দরকার। এখনই!