সরকারের কাছে জনগণের যা ন্যায্য পাওনা

একটি স্বাধীন দেশে জনগণ সংগতভাবে আশা করে, সরকারের সেবাদানকারী সংস্থাগুলো থেকে তারা দ্রুত ও ন্যায্য সেবা পাবে। বেসরকারি সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর সেবার মান, মূল্য ইত্যাদির ওপরও সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ নজরদারি করবে। এগুলোর আকৃতি ও প্রকৃতি বহুবিধ। বিপন্ন মানুষ ছুটে যায় থানায়। থানার কাজ দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। প্রয়োজনে জনগণকে যেতে হয় ভূমি অফিসে। সে অফিসের দায়িত্ব ভূমি রেকর্ড যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও নিয়মমতো সংশোধন করা। রোগীকে যেতে হয় হাসপাতালে। সেখানে তারা চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রাখে। শিল্পমালিকের উদ্যোগ ও বিনিয়োগের ফসল কলকারখানা। এগুলোর যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য আমদানি-রপ্তানি নিশ্চিত করতে আবশ্যক হয় সরকারি সেবা। আবার এসব কারখানার শ্রমিকেরা ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন কি না, তা নিশ্চিত করতে হয় সরকারকে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, চোরাচালান প্রতিরোধ থেকে নদীভাঙন ঠেকানো—সবই সরকারের কাজ। শিক্ষা খাতে সরকারই মূল ভূমিকায়। আবার বিভিন্ন আর্থিক পরিকল্পনার মাধ্যমে কর্মসংস্থান, নাগরিকদের আয় বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যের বৃত্ত থেকে বের করে আনাও সরকারেরই দায়িত্ব। অবশ্য সব কাজ সরকার সরাসরি করে না। তবে অনুঘটক হতে হয়। বেসরকারি সংস্থাগুলোকে দিতে হয় প্রয়োজনীয় প্রণোদনা। পাশাপাশি রাখতে হয় তদারকি। এর মধ্য দিয়েই একটি জাতি ক্রমান্বয়ের সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হয়। তা পরিচালনা করার মূল দায়িত্ব সরকারেরই।

গণতান্ত্রিক দেশে সরকার গঠিত হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচন সামনে এলেই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো সরকার গঠন করলে সে মেয়াদে প্রধান প্রধান কী কাজ করবে, তার একটি ইশতেহার ঘোষণা করে। যাঁরা বিজয়ী হন, তাঁদের জন্য কার্যত ইশতেহারটি দেশবাসীর সঙ্গে একটি চুক্তি বলে গণ্য করা যায়। প্রকৃতপক্ষে, এতে মৌলিক বিষয়াদিই থাকে। খুঁটিনাটি থাকার সুযোগ নেই। তবে এটি অনেক খোলা হাতেই লেখা হয়। এর সবকিছু বাস্তবায়ন করা হয় না। তবে মৌলিক বিষয়াদি উপেক্ষিত বা বিপরীতমুখী না হোক—এটা দেশবাসীর স্বাভাবিক প্রত্যাশা। একনাগাড়ে তিনবার ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ নির্বাচনের আগে এমনই একটি ইশতেহার জাতির সামনে তুলে ধরেছিল। হতে পারে এতে অপূর্ণতা আছে। ব্যাখ্যা নেই ২০০৮ ও ২০১৪ সালের ইশতেহারের কিছু মৌলিক বিষয় উপেক্ষার। তা সত্ত্বেও এ ইশতেহার নিয়েই আমরা আশায় বুক বাঁধতে চাই।

আগামী পাঁচ বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে উন্নীত করার প্রত্যয় প্রশংসনীয়। অর্থনীতির হালচাল বলে, এটা বাস্তবসম্মত। বলা হয়েছে, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশ দারিদ্র্যমুক্ত হবে। আমরা এমনটাই চাই। তবে আয়বৈষম্য বাড়ছে। এটা থামাতে না পারলে সামাজিক অসন্তোষ বাড়তে থাকবে। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ কয়েক দশক আগেও তাদের সেবার অগ্রাধিকারে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের রাখত। এখন সে স্থানে এসে পড়েছে উচ্চবিত্তরা। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি ধনিকশ্রেণির প্রয়োজন আছে। তবে এত বেশি আয়বৈষম্য যৌক্তিক নয়। বৈষম্য কমাতে করব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। শ্রমমজুরি ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে যেতে হবে।

বিদেশে ব্যাপক কর্মসংস্থানের একটি লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়েছে। তবে দেশের শ্রমবাজারে ক্রমবর্ধমান হারে বিদেশিদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে কিংবা ভ্রমণ ভিসায় এ দেশে এসে অনেক লোক কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছেন। ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল ডেইলি সান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে দেখা যায়, এভাবে বছরে ২০০ কোটি ডলার বিদেশে চলে যাচ্ছে। হিসাবের বাইরে অনেক বেশি যাচ্ছে বলে কেউ কেউ ধারণ করেন। নিয়োগদাতাদের অনুরাগের বশে বেশি বেতন দিয়ে বিদেশি কর্মী নিয়োগ দেওয়ার কথা নয়। প্রকৃতপক্ষে দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাবই এর কারণ। আমাদের অনেক তরুণ-তরুণী ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার অভাবে চাকরি পান না। এই অসম্পূর্ণতা কাটানোর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

সুশাসনের পথে একটি বড় বাধা দুর্নীতি। আমাদের দুর্নীতিসংক্রান্ত আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় তেমন কোনো ঘাটতি আছে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। আমরা এ ঘোষণার পক্ষপাতহীন বাস্তবায়ন দেখার অপেক্ষায় রইলাম। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী করার ঘোষণাকেও স্বাগত জানাতে হয়। বিশেষ করে বিচারবহির্ভূত হত্যা মামলাগুলোর বিশেষ তদন্ত ও পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার আইনি সুযোগ থাকা প্রয়োজন। মানবাধিকার কমিশনের আরও সক্রিয় হওয়া উচিত। প্রকৃতপক্ষে, এই প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব সম্পর্কে দেশের খুব কমসংখ্যক মানুষই অবগত আছেন। বিচার বিভাগ শক্তিশালী করার কথাও ইশতেহারে আছে। বিচারব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ প্রসিকিউশন টিমকে শক্তিশালী ও সক্রিয় না করলে সুফল পাওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা রাজনৈতিক পক্ষপাতহীন হওয়া সংগত।

পরিবহন খাত, বিশেষত ঢাকা মহানগরীর পরিবহনব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। আশ্বাস দেওয়া হয়েছে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার। এ বিষয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ এই সরকারই আগের মেয়াদগুলোয় শুরু করেছে। কাজটি সহজ নয়, কিন্তু আমাদেরই তা করতে হবে। যানবাহনের যেখানে-সেখানে পার্কিং, বেপরোয়া গতি ইত্যাদি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ভোগান্তি বেশ কিছুটা কমবে। যানবাহন পার্কিংয়ের স্থান ছাড়া যেসব স্থাপনা, বিশেষ করে মল, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি স্থাপন করা হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে একটা কিছু ব্যবস্থা নিতেই হবে। যানজটে বড় ভূমিকা রাখছে এই স্থাপনাগুলো।

আওয়ামী লীগের ইশতেহারে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ সমাজের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর জন্য জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের একটি প্রতিশ্রুতি আছে। এটা প্রয়োজনীয় এবং দেশের সব সম্প্রদায়ের মধ্যে ভালো সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। পাশাপাশি পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীগুলোর আর্থসামাজিক অবস্থান ও প্রত্যাশা সামনে নিয়ে এলে সমাধানের ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। তাদের ব্যক্তিগত ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জাতীয় কর্তব্য। বিষয়টি খুব ব্যয়বহুল বা সময়সাপেক্ষ হওয়ার কথা নয়।

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়তেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। তাঁরই স্বপ্ন ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতামুক্ত একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য দরকার দক্ষ জনশক্তি। মেধাবীদের যোগ্য স্থানে নিয়োগদানের মাধ্যমে এ চাহিদা পূরণ করা যায়। আওয়ামী লীগ সরকার গত বছর নিয়োগপর্বে কোটা সমস্যার সমাধান করেছে। এর সুফল পাওয়া যাবে বছর দশেক পর থেকে। তবে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন পদায়নকালে যথোপযুক্ত কর্মকর্তা চিহ্নিতকরণ। পদোন্নতির প্রক্রিয়াতেও মেধাই একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হলে সুফল পেতে খুব বিলম্ব হবে না।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অঙ্গীকার রয়েছে যে সংসদকে আরও কার্যকর ভূমিকায় নিতে সদা সচেষ্ট থাকবেন তাঁরা। নির্বাচনের ফলাফলে দলগত অবস্থান বিষয়টিকে কঠিন ও জটিল করেছে। জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে থাকলেও তারা মহাজোটের অংশীদার। একই প্ল্যাটফর্ম থেকে নির্বাচন করেছে। তার মধ্যেও আইনপ্রণেতারা সংসদের কাজে অধিকতর মনোনিবেশ করলে পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন হতে পারে। প্রশ্নোত্তর, সিদ্ধান্ত প্রস্তাব বা জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কোনো বাধা হয়ে সামনে আসার কথা নয়। এর মধ্যে বিরোধী দল ছাড়াও নিজ-দলীয় সাংসদেরাই সরকারকে বেশি পরিমাণ জবাবদিহির মধ্যে রাখতে পারেন। সংসদীয় কমিটিগুলো হতে পারে প্রাণবন্ত।

সরকার গঠনের পর্ব শেষ হওয়ার পর ইশতেহার বাস্তবায়নের দায়ভার সামনে চলে আসে। জনগণ অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি শাসনব্যবস্থায় সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতি দেখতে চায়। সেটাই সুশাসন। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে তৎপর হবে—এটাই সবার প্রত্যাশা।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]