ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনুন

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের তদন্ত ও বিচারের কাজের অগ্রগতি শূন্য
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের তদন্ত ও বিচারের কাজের অগ্রগতি শূন্য

নতুন বছরে নতুনভাবে নির্বাচিত সংসদ। মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য নবীন না হলেও মন্ত্রী হিসেবে নতুন। নতুনদের নিয়ে গঠিত সরকারের প্রতি মানুষের আগ্রহ রয়েছে। তবে প্রত্যাশা ভিন্ন কারণে। টানা ১০ বছর সরকার পরিচালনার পর নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের কারণে জনগণের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। বিগত ১০ বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চমৎকার থাকলেও সুশাসনের অভাব তথা সর্বব্যাপী দুর্নীতি নিয়ে ব্যাপক অস্বস্তি ছিল। এখন শক্তিশালী সরকার এসব অস্বস্তি নিবারণে সক্ষম হবে, এমন প্রত্যাশাও রয়েছে।

ব্যাংকিং খাতের ঘটনাবলি স্মরণ করা যাক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর কখনো ব্যাংক খাতের ব্যাংকমালিকদের সঙ্গে তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে বৈঠক করেন না। এটা সারা বিশ্বে পালিত একটি নিয়ম। আগে বাংলাদেশেও ঘটেনি। ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’-এর কারণে এ ধরনের নৈতিক নিয়মকানুন মেনে চলা হয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব অঘটনটা ঘটালেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে ডেকে একটি হোটেলে ব্যক্তি খাতের ব্যাংকমালিকদের সঙ্গে বৈঠক করলেন। এটা কি সুশাসনের নমুনা? শুধু তা-ই না। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজেদের নিয়মে ধার্য করা ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও বা সিআরআর হ্রাস করা হলো। আমানতকারীর স্বার্থে নয়, ব্যাংকমালিকদের স্বার্থে। এই কি সুশাসনের নমুনা? ব্যাংকমালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা থেকে আমানতধারীদের নিরাপত্তা রক্ষা করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। ব্যাংকমালিকদের প্রভাবে কাজ করল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটাকে শুধু সুশাসনের অভাব বললে হবে না, এটা রীতিমতো নৈতিক স্খলন।

দেশের অন্যতম সেরা ব্যাংক ছিল বেসিক ব্যাংক। যার শ্রেণিকৃত ঋণ ছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশ। ইউরোপীয় অনেক ব্যাংকের চেয়ে ভালো। সরকার নিয়োজিত একজন চেয়ারম্যান এই ব্যাংকের ৮০ শতাংশ টাকা ঋণের নামে সরিয়ে ফেলেন। এখনো ৬০ শতাংশ ঋণ অনাদায়ি। আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ! এটা কি সুশাসনের নমুনা! কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করার পর সর্বশেষ অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ রেখেছিল যে ওই চেয়ারম্যান মহোদয়কে অপসারণ করা হোক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পত্র গুরুত্ব পায়নি। চেয়ারম্যান মহোদয় তাঁর মেয়াদ শেষের এক দিন আগে পদত্যাগ করে সসম্মানে চলে গেলেন। এই হলো সুশাসনের নমুনা! তারপরও এত বড় ঘটনার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ন্যূনতম আইনি ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। তিনি কি আইনের ঊর্ধ্বে? যে শক্তি তাঁকে সুরক্ষা দিয়েছে এবং দিচ্ছে, সে শক্তি কি আইনের ঊর্ধ্বে? সুশাসন যদি আইনের শাসন নির্দেশ করে, তাহলে বেসিক ব্যাংকের ঘটনা সুশাসন নির্দেশ করে না।

উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। বিষয়টি বহুল আলোচিত। ঘটনাবলির জন্য অনেক ব্যক্তি এবং অনেক শক্তিই দায়ী। কিন্তু মূল দায়িত্ব থেকে যায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওপর। ইতিহাসের কাছে তিনি দায়ী থেকেই যাবেন। নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এ পর্যন্ত যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে বোঝা যায়, তিনি বিষয়গুলো জানেন। তিনি একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। আর্থিক বিষয়গুলোর ভেতরে প্রবেশ করার জ্ঞান তাঁর রয়েছে। তাঁর প্রাথমিক কথাবার্তায় যথেষ্ট প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। মানুষের প্রত্যাশাও বেড়ে গেছে। মানুষের প্রত্যাশা আর মন্ত্রীর প্রত্যয়ের সমন্বয় ঘটুক—এটাই সবার আশা।

সমস্যা সমাধান এবং প্রত্যাশা পূরণের জন্য কিছু সুপারিশ রাখা যেতে পারে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারায় গুরুতর অভিযোগে ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক অথবা ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। বলা হয়েছে, ধারাটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। একইভাবে ওই আইনের ৪৭ ধারায় ব্যাংকের সম্পূর্ণ পর্ষদকে অপসারণ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে এবং এ ধারাটিও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না মর্মে আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায় একই দেশে দুজনের জন্য দুই রকম আইন, যাকে বলে ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’। দেশের সব তফসিলি ব্যাংক একই কাজ করে থাকে। অগ্রণী-জনতা ব্যাংক যে কাজ করে, পূবালী-প্রাইম ব্যাংক হুবহু একই কাজ করে। তাহলে দুই রকমের আইন কেন?

সরকারের অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত কর্মকর্তারা সরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান-পরিচালক হয়ে থাকেন। তাঁরা চান না বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁদের ওপর খবরদারি করুক। আবুল মাল আবদুল মুহিতও একজন সাবেক আমলা। তাই আমলা-সুরক্ষা আইনটি রয়ে গেছে। এখন এ আইনের ফলাফল দেখা যাক। আইন দুটি ব্যক্তিমালিকানার ব্যাংকগুলোর ওপর প্রযোজ্য বিধায় ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর শ্রেণিকৃত ঋণের গড় হার ৬ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে। সরকারি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নিয়ন্ত্রণমুক্ত এবং তাদের শ্রেণিকৃত ঋণের গড় হার ৩০ শতাংশের ওপর। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সুশাসনের বিপরীত অবস্থানের মূল কারণ ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ও ৪৭ ধারা। অতএব, সুপারিশ করা যাচ্ছে, আইনটি সংশোধন করে সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের ওপর প্রযোজ্য করতে হবে।

বর্তমান অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে দেশের ব্যাংকগুলোর গড় শ্রেণিকৃত ঋণ ১৩ শতাংশ। সংখ্যাতত্ত্বের দিক থেকে কথাটা ঠিক। কিন্তু ভালো আর মন্দের মধ্যে যখন বিশাল পার্থক্য, তখন গড় সংখ্যা ভালোর প্রতি অবিচার এবং মন্দকে ঢেকে রাখার প্রয়াস হয়। আমার সুপারিশ থাকবে, ব্যাংকগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করে ফেলুন—১. যেসব ব্যাংকের শ্রেণিকৃত ঋণ ১০ শতাংশের ওপর এবং ২. যেসব ব্যাংকের শ্রেণিকৃত ঋণ ১০ শতাংশের কম। প্রথম ভাগে পড়ে যাবে সব সরকারি ব্যাংক এবং গুটিকয়েক বেসরকারি ব্যাংক। দ্বিতীয় ভাগে পড়বে অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংক। এমন বিভাজনে দেশের ৫০টি ব্যাংককে ভালোর কাতারে রেখে গোটা দশেক ব্যাংককে মন্দ তালিকায় রাখা যাবে। এতে করে ব্যাংকিং সেক্টরে ভালো দিক ফুটে উঠবে এবং মন্দ ব্যাংকের ওপর নজর রাখার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

একটি শক্তিশালী ব্যাংক খাতের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী ও স্বনিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে উল্লিখিত ঘটনাবলির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থা নাজুক। নিজ উদ্যোগে দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে উচ্চ নির্বাহীরা আগ্রহী হচ্ছেন না। ওপরের হুকুম পালনের প্রবণতা লক্ষণীয়। এ অবস্থা থেকে তাঁদের মুক্ত করতে হবে। দক্ষতা যতটুকুই আছে, পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার প্রো-অ্যাকটিভ ভূমিকা পালন করতে পারে। উল্লেখ্য, ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার কখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কোনো নির্দেশ দেয় না। এই তো সেদিন প্রথমবারের মতো মোদি সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি সুপারিশ করেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অপারগতা জানিয়ে পদত্যাগপত্র পেশ করেছিলেন। সরকার সুপারিশের বিষয়ে পরে চাপ না দিয়ে গভর্নরের পেশাগত দক্ষতার প্রশংসা করেছিল।

 ব্যাংক খাত নিয়ে কিছু কথা বলা হলো। এখন সার্বিক বিষয়ে নাগরিক সাধারণের উত্কণ্ঠা ও প্রত্যাশার বিষয়ে আলোচনা করা যাক। দেশে সুশাসনের সার্বিক অভাব এবং দুর্নীতির ব্যাপক প্রভাব নিয়ে জনগণ চিন্তিত। জনগণের প্রত্যাশা সুশাসনের পথে অন্তত পা রাখা এবং দুর্নীতি হ্রাসে লক্ষণীয় কিছু কর্মকাণ্ড। সমস্যা দুটি একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দুর্নীতি হ্রাসকরণ ছাড়া সুশাসন সম্ভব নয়। আবার সুশাসনের অভাব থাকলে দুর্নীতি কমানো সম্ভব না। এই সমস্যা দূরীকরণ সহজসাধ্য নয়। জনগণ নেতৃত্বের পূর্ণ সদিচ্ছা এবং সঠিক পথে চলার শুরুটা দেখতে চায়।

দুর্নীতিবাজ ও অদক্ষ মানুষ দুর্নীতি রোধ করতে পারে না। ‘রুল অব থাম্ব’ অনুযায়ী যুগ্ম সচিব থেকে উচ্চপদগুলো এবং বিভিন্ন সংস্থা প্রধান পদে পরীক্ষিত সৎ ও দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে। পাশ্চাত্যের নিয়মে ‘প্যারালাল’ বা সমান্তরাল নিয়োগ অধিকতর ফলপ্রসূ হতে পারে, যদি বাছাই পর্ব ‘প্রফেশনাল’ভাবে করা যায়। সুশাসনের জন্য আরেকটি অবশ্যকরণীয় কাজ হচ্ছে ‘ইনস্টিটিউশনাল ডেভেলপমেন্ট’। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থাকে আইনের অধীনে স্বাধীনভাবে চালাতে হবে। সরকারি বা শক্তিশালী মহল থেকে হস্তক্ষেপ দূরের কথা, প্রভাবিত করা যাবে না। তবে এ রকম পরিবেশের জন্য প্রতিটি সংস্থা থেকে দুর্নীতি, দুর্বলতা ও অপসংস্কৃতি ঝেড়ে ফেলতে হবে এবং উচ্চতর পেশাগত যোগ্যতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা দিয়ে পরিচালিত করতে হবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের জন্য অনাবশ্যকভাবে গভর্নর, ডেপুটি গভর্নরদের সরানো হলেও তদন্ত ও বিচারের কাজে অগ্রগতি শূন্য। অথচ ফিলিপাইন স্বপ্রণোদিত হয়ে বিচার করে একজন ব্যাংক ম্যানেজারকে ইতিমধ্যে শাস্তি দিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশ মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েও মামলা এখনো দাখিল করতে পারেনি। সাবেক অর্থমন্ত্রীর বিদায়ের পর আমাদের প্রত্যাশা, দেরিতে হলেও এখন অন্তত কেস ফাইল যেন করা হয় এবং যোগ্য আইনজীবী নিয়োগ করা হয়।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর

lনতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা নিয়ে নানা বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের লেখা ছাপা হচ্ছে। আমরা এসব লেখা নিয়ে পাঠকদের মন্তব্য, প্রতিক্রিয়া পাঠানোর আহ্বান জানাচ্ছি। —বিভাগীয় সম্পাদক

আরও পড়ুন: