সন্ধ্যা হলেই প্রশ্ন, 'বাসায় ফিরেছ?'

প্রতীকী ছবি। ছবি: সুমন ইউসুফ
প্রতীকী ছবি। ছবি: সুমন ইউসুফ

আমার এক বাল্যবন্ধুর মা ও স্ত্রী দুজনই চাকরিজীবী। নিজেও সে চাকরি করে। অফিসে আসার পর নিয়ম করে মা ও স্ত্রীর খোঁজ নেওয়া তার রুটিন। তাঁরা নিরাপদে অফিসে পৌঁছালেন কি না। আবার বিকেল-সন্ধ্যায় ফোন করে তার জিজ্ঞাসা: নিরাপদে বাসায় ফিরলেন কি না! যতক্ষণ নিশ্চিত খবরটুকু না আসে, স্বস্তি মেলে না বন্ধুটির।

অফিস হোক বা হোক অন্য কাজ, সন্ধ্যা ঘনাল তো বাসার ফেরার তাড়ায় থাকেন বেশির ভাগ নারী। কর্মজীবী নারীর জন্য এ যেন প্রতিদিনের উদ্বেগ। কারণ কী? উত্তর হলো নিরাপত্তাহীনতা। আমাদের সমাজে অনেক কিছু নিয়েই নিরাপত্তাহীনতা আছে। জীবিকা থেকে শুরু করে জীবন পর্যন্ত—সবকিছুতেই নিরাপত্তার পাশে বিরাট এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন। এর মধ্যে শারীরিক নিরাপত্তা ও সম্মান নিয়ে ভয়টা মনে হয় সবচেয়ে বেশি। এমন শঙ্কা অনেক পুরুষেরও। সম্মান যেন খোয়াতে না হয়, তার জন্য যদি চোখ বুজে থাকতে হয়, তাও সই!

‘মেয়ে মানুষ কেন এত রাতে বাইরে থাকবে?’

এসব সতর্কতার একটি হলো প্রিয়জনেরা যেন নিরাপদে থাকে, সেই চেষ্টা করা। মা-বোন-স্ত্রী-কন্যা যেন পথে নিরাপদে থাকেন এবং সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বাসায় ফিরে আসেন। এই প্রত্যাশায় থাকেন সব স্বজন, যাঁদের বড় অংশই আবার পুরুষ। এই পুরুষেরা আসলে কাদের ভয়ে ভীত? অন্য পুরুষে তাদেরও ভয়। আমরা সব সময় প্রার্থনা করি, যেন কোনো পুরুষের দ্বারা আমাদের মা-বোনেরা মানসিক বা শারীরিক ‘হয়রানির’ শিকার না হন। রাস্তায় একদল ছেলেকে দেখলে একলা মেয়েটা মনে মনে ‘উত্ত্যক্তের শিকার’ হওয়ার আশঙ্কায় ভোগেন। তখনই হয়তো আরেকটি ছেলে মনে মনে চাইতে থাকে, যেন বাইরের ছেলেদের হাতে তার বোনকে নিগৃহীত হতে না হয়। এবার বলুন তো, কে বেশি ঝুঁকিতে? পুরুষের ভয়ে থাকা নারীরা? নাকি একদল পুরুষের ভয়ে ভীত আরেক দল পুরুষ? এমনকি নিপীড়ক মানসিকতা লালন করা কিংবা নিপীড়নে হাত পাকানো পুরুষেরাও হয়তো চায়, তাদের আপন নারীরা যেন তাদেরই মতো পুরুষের হাত থেকে নিরাপদ থাকেন।

নারী-পুরুষের সমতার কথা বলা আধুনিকতা। কিন্তু আমরা আধুনিক হয়েছি কেবলই বহিরঙ্গে। তাই যৌন হয়রানির দোহাই দিয়ে পয়লা বৈশাখে সন্ধ্যার পর অনুষ্ঠান আয়োজন বন্ধ করা হয়। কারণ, যৌন নিপীড়কদের পুরোপুরি ঠেকানোর কোনো নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারি না। তাই প্রতিরোধের বদলে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার পথ খুঁজি। মনে করি, মাথায় যখন ব্যথা, মাথা কেটে ফেললেই তো হয়! আবার কোনো ঘটনায় আলোড়ন সৃষ্টি হলেও কারও কারও উদ্দেশ্য থাকে ভিকটিমের চরিত্র হনন করা। একজনকে জোর করে নিচে নামিয়ে যদি নিজেদের দোষ ঢেকে রাখা যায়, তবে মন্দ কী!

৩ থেকে ৮৩ বছর
আর তাই আমরা ধীরে ধীরে নারীদের ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। সন্ধ্যা হলেই বোনকে ফোন করে বলি, ‘এখনো বাসায় যাওনি কেন? তাড়াতাড়ি যাও।’ কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহসটা দেখাতে চাই না। কারণ, প্রতিবাদ তো ঝামেলার কাজ। আমাদের সাধারণ ভাবনা এখন এমন, ‘মেয়ে মানুষ কেন এত রাতে বাইরে থাকবে?’ এই ভাবনার নাগপাশ থেকে আমরা আর বের হতে পারছি না। সুয্যিমামা অস্ত গেলে ভয়টা যেন আরও জেঁকে বসে। সন্ধ্যা হলেই ভাই ফোন দেন বোনকে, ছেলে ফোন দেয় মাকে, প্রেমিক ফোন দেন প্রেমিকাকে—সবার প্রশ্ন একটাই, ‘বাসায় ফিরেছ?’

এই প্রশ্ন যাঁরা করেন, তাঁদেরও–বা কী দোষ। কী অস্বাভাবিক পরিবেশে মানসিক চাপে পড়ে আমি আমার মা-বোনদের বাসায় ফেরার তাড়া দিই, তা ভুক্তভোগীমাত্রই বোঝে। নতুন বছরের শুরুতেই আমরা শুনেছি নির্বাচনের দিনে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে এক গৃহবধূকে ধর্ষণের খবর। এরপর এক মাদ্রাসাছাত্রীকে দিনের পর দিন আটকে ধর্ষণ করার অভিযোগও শুনেছি। দেখেছি দুধের বাচ্চাদের ধর্ষণে ব্যর্থ বা সফল হয়ে মেরে ফেলার বিভীষিকাময় সংবাদ। ৩ থেকে ৮৩ বছর বয়সী শিশু ও নারী, আধুনিকা কিংবা হিজাবি কেউই তো বাদ পড়ছে না। এত সব দেখে পুরুষ হিসেবে আরেক পুরুষের ওপর ভরসা রাখি কী করে? তাও যদি এসব ঘটনার বিচার ঠিকভাবে হতো, তখন হয়তো কিছুটা ভরসা পাওয়া যেত।

গত বছর চালানো প্রথম আলোর এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ধর্ষণ, যৌন পীড়নের মতো ছয়টি নির্দিষ্ট অপরাধে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা মামলায় ৯৭ শতাংশ ক্ষেত্রে সাজা হয়নি। ২০০২ থেকে ২০১৬—এই ১৫ বছরে দায়ের করা ৭ হাজার ৮৬৪টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে এই ফলাফল পাওয়া গেছে (সাজা মাত্র তিন শতাংশ, প্রথমা প্রকাশন)। ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগগুলো টেকেনি। আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলাগুলোরও প্রায় একই হাল

এবার বলুন নারীই হই বা হই পুরুষ, ভয় না পেয়ে করব কী?

প্রতীকী ছবি। ছবি: সুমন ইউসুফ
প্রতীকী ছবি। ছবি: সুমন ইউসুফ

নারীর ঘর ও বাহির
অথচ মানবসভ্যতার শুরুতে নারীরা এতটা ‘নিরাপত্তাহীনতায়’ ভুগত না। প্রস্তর যুগে প্রথম ঘর বা বাড়ির ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল মানুষের মধ্যে। এরও অনেক পরে কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রসার লাভ করে। কৃষিভিত্তিক সমাজে শুরুতে নারীরাই ছিলেন চালকের আসনে। ধীরে ধীরে কৃষিব্যবস্থা যত সহজ হয়েছে, তত নারীদের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে পুরুষ। অর্থ উপার্জনের উপায়গুলোর চাবিকাঠি পুরুষ নিজেদের হাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছে সব সময়। আর সেই জায়গা থেকেই তৈরি হয়েছে নারী-পুরুষে বৈষম্য।

পশ্চিমা সমাজে অবশ্য নারীরা ধাপে ধাপে নিজেদের হারিয়ে যাওয়া অধিকার বেশ খানিকটা ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন। তারপরও কেবল গত শতাব্দীতেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার পেয়েছেন নারীরা! পশ্চিমা গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ঠোকাঠুকির প্রতিক্রিয়ায় নারীদের ভোটাধিকার পরে আরও বিস্তৃত হয়েছে। এখন কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছেন নারীরা। অবশ্য নিপীড়নের হাত থেকে রেহাই মেলেনি উন্নত দেশের নারীদেরও। ওয়ার্কপ্লেস বুলিং ইনস্টিটিউটের করা ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে কর্মক্ষেত্রে বুলিং করা বা উত্ত্যক্তকারীদের মধ্যে ৭০ শতাংশই পুরুষ এবং ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাদের শিকার হন নারীরা। মনে রাখতে হবে, যৌন হয়রানির যথেচ্ছ ঘটনার কারণেই কিন্তু গড়ে উঠেছে হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন এবং এই আন্দোলনের ঢেউ লেগেছে এ দেশেও।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

অর্থাৎ নারীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শেষ হয়ে যাওয়ার সময় আসেনি। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে তা আরও তীব্র। এই লড়াইয়ে সহযোগী না হয়ে আমাদের মতো তথাকথিত পুরুষেরা তার প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছি। ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনায় ভিকটিমের পাশে না দাঁড়িয়ে তাঁর পোশাক নিয়ে প্রশ্ন তুলছি। এটি কি এককথায় ধর্ষকের প্রতি পক্ষপাতের প্রকাশ না? এটা নিয়ে কতজন ভাবি, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি? অন্যের ঘাড়ে অযথা দোষ চাপানো কি আমাদের জাতীয় অভ্যাস হয়ে গেছে?

ইদানীং আবার শোনা যাচ্ছে, মেয়েদের নাকি স্কুল-কলেজে পাঠানো ঠিক নয়। আচ্ছা, কোনো নারী যদি এভাবে বলে দেন যে ছেলেদের স্কুল-কলেজে পাঠানো ঠিক নয়, রাস্তায় স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে দেওয়া ঠিক নয়। কেননা, একশ্রেণির পুরুষের জন্যই তো নারীদের এত ভয়! তখন কি এ দেশের পুরুষেরা তা চুপচাপ শুনে যাবেন?

ঐতিহাসিকেরা বলেন, খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বছর আগে তুরস্কে প্রথম একটি শহর গড়ে উঠেছিল। সেখানকার ঘরগুলোয় নাকি আজকালকার মতো প্রচলিত দরজা ছিল না। লতাপাতায় তৈরি ছাদ দিয়ে মানুষেরা খুপরি আকারের ঘরে ঢুকত। এরপর আটকে দিত ছাদ। আমাদের অবস্থাও হচ্ছে সে রকম। মানসিকতায় পরিবর্তন না আসায় আমরা পুরুষেরা ঢুকে যাচ্ছি মনের খুপরিতে, যেখানে দরজা নেই, জানালাও বেশ ছোট। সেখানে আলো-বাতাসের বড্ড অভাব। শুধু অন্ধ ও বধির হলেই তাতে নীরবে দিনাতিপাত করা যায়!