সংসদে না থাকলেও বিরোধী দল হয়

গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আটটি আসনে জয়ী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচিত সাংসদেরা শপথ নেবেন কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক চলছে। সরকারি দলের নেতারা ‘গণতন্ত্রের স্বার্থে’ তাঁদের সংসদে যাওয়ার সদুপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন। আর বিএনপির নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন, যেখানে বিরোধী দল ভোটই করতে পারেনি, সেখানে সংসদে গিয়ে কী হবে? সংসদে গিয়ে কী হবে, সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই সরকারি দল নির্বাচনোত্তর সংলাপ নিয়ে নতুন বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। এক নেতা বলেছেন, সংলাপ নয়, শুভেচ্ছা বিনিময়। আরেক নেতা বলেছেন, না প্রধানমন্ত্রী সংলাপই করবেন। দেখা যাক, কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়।

বিরোধী দল থাকা না–থাকার বিতর্কটি এখন রাজনৈতিক অঙ্গন ছাড়িয়ে আদালতে গিয়ে ঠেকেছে। ১২ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৯-এ নাইকো দুর্নীতির মামলার শুনানিকালে অন্যতম আসামি ও বিএনপির নেতা মওদুদ আহমদ শুনানিতে অংশ নিয়ে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারই নাইকোর সঙ্গে চুক্তি করেছিল। আমরা শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছি। যারা করেছে তারা আজ আসামির বাইরে। বলতে দ্বিধা নেই, আমরা এখন বিরোধী দলে তাই...।’

এ সময় দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন ওরফে কাজল বলেন, ‘আপনারা তো এখন বিরোধী দলে নেই।’ জবাবে হুইলচেয়ারে বসে থাকা খালেদা জিয়া বলে ওঠেন, বিরোধী দল শুধু পার্লামেন্টের ভেতরে থাকলেই হয় না, বাইরে থাকলেও হয়। আবার এখন দেখি, বিরোধী দল সরকারের সঙ্গে থেকেও হয়। যারা জনগণের জন্য কথা বলে, তারাই বিরোধী দল।

বিএনপি দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দল। ১৯৭৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তাতে সেটাই প্রমাণিত হয়। বিএনপি এ পর্যন্ত সাতটি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে চারটিতে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে। আর আওয়ামী লীগ ১৯৭৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নয়টি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে পাঁচবার সরকার গঠন করেছে। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ২০১৪ সালে। আর আওয়ামী লীগ বর্জন করেছে ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ (১৫ ফেব্রুয়ারি) সালের নির্বাচন। অতএব, নির্বাচন বর্জন কিংবা সংসদ বর্জনের খতিয়ান নিয়ে বিরোধী দলের অস্তিত্ব নিরূপণ করা যায় না।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই নির্বাচন বর্জন করেছে, কখনো একে অপরের বিরুদ্ধে, কখনো একযোগে। ১৯৮৬ সালে এরশাদনিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও বিএনপি বর্জন করে। আবার ১৯৮৮ সালের নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একযোগে বর্জন করেছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। ১৯৮৮ সালের নির্বাচন বর্জন করায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিরোধী দল হিসেবে পরিচয় দিতে কোনো সমস্যা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। বরং সংসদের বাইরের বিরোধী দল হয়ে তারা যুগপৎ আন্দোলন করে দুই বছরের মাথায় স্বৈরাচারী এরশাদকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিল।

যদি নির্বাচন বর্জন করা বা সংসদে না থাকার কারণে বিরোধী দল না হয়, তাহলে তো ওই সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ার কথা। এর চেয়েও মোক্ষম উদাহরণ হলো ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছিল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, জাসদ, কমিউনিস্ট পার্টিসহ প্রায় সব বিরোধী দল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ১৯৯১ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও সংসদে ছিল তিন বছর। বাকি দুই বছর সংসদের বাইরে থেকে রাজপথে আন্দোলন করেছে। এমনকি ১৯৯৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে গড়ে তোলা আন্দোলনের একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলের ১৪৭ জন সাংসদ পদত্যাগ করেছিলেন। এরপরও বছর দেড় সংসদ বহাল ছিল। সংসদে না গেলে যদি বিরোধী দল না থাকে তাহলে তো তাদের কী পরিচয় ছিল? একইভাবে সপ্তম সংসদেও দীর্ঘ সময় তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি, জাতীয় পার্টির একাংশ, জামায়াতে ইসলামীর সাংসদেরা বর্জন করেছিলেন। প্রায় অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে অষ্টম সংসদে বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে। আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগীরা দীর্ঘ সময় সংসদ বর্জন করে আন্দোলনের জন্য রাজপথকেই বেছে নিয়েছিল। সেই আন্দোলনে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল যেমন ছিল, তেমনি সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই, তারাও ছিল।

২০০৯-২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি ও তার সহযোগীরা অনুরূপ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে। দুই আমলেই বিরোধী দলের পরিচয় নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। বিরোধী দলের পরিচয় নিয়ে জোরালো প্রশ্ন উঠল ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর। সেই নির্বাচন বিএনপিসহ নিবন্ধিত অধিকাংশ দল বর্জন করলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল ও জাতীয় পার্টি অংশ নেয়। মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি থেকে তিনজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। আর দলের প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। সংসদে স্বীকৃত বিরোধী দল কার্যক্ষেত্রে যে বিরোধী দলের ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে, সে কথা এরশাদ ও তাঁর পত্নী রওশন এরশাদ বহুবার বলেছেন। তখন সংসদে না থেকেও বিএনপিই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছিল, অতীতে যেমনটি করেছিল আওয়ামী লীগ।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আদালতে পার্লামেন্টে না থাকলেও বিরোধী দল হয় বলে যে মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তার যথার্থতা অস্বীকার করা যায় না। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা হওয়া উচিত সরকারের ভুলত্রুটি তুলে ধরা এবং সরকার যাতে জনস্বার্থবিরোধী কোনো আইন করতে না পারে, সেসব বিষয়ে প্রতিবাদী হওয়া। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি দল কখনোই বিরোধী দলের সমালোচনা শুনতে চায় না। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সরকারি দলের সাংসদেরাও সরকারের সমালোচনা করেন, বিলের বিরুদ্ধে ভোটও দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ জুড়ে দিয়ে সাংসদদের সেই অধিকার পুরোপুরি খর্ব করা হয়েছে। তাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া দূরে থাক, টুঁ–শব্দও করতে পারেন না বা করতে দেওয়া হয় না।

বিস্ময়কর হলেও সত্য, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলগুলো সংসদের চেয়ে সংসদের বাইরেই বেশি ভূমিকা রেখেছে। আন্দোলন করে সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায় করেছে। এটি আওয়ামী লীগের জন্য যতটা সত্য, বিএনপির জন্যও ততটা সত্য। দশম সংসদে যাঁরা বিরোধী দলে ছিলেন, বলতে গেলে ধন্যবাদ জ্ঞাপন ছাড়া তাঁদের কোনো ভূমিকাই ছিল না। অনেকে ঠাট্টা করে বলতেন, দো-আঁশলা বিরোধী দল। এবার কী আদলের বিরোধী দল হবে, তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

সংসদে বিরোধী দলের সদস্যের সংখ্যা যত কমই হোক, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে চললে তাঁরাও কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেন। বাংলাদেশ গণপরিষদে বিরোধী দলের সদস্য ছিলেন দুজন—সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। এই দুজনই যে গণপরিষদকে কতটা সরগরম রেখেছিলেন, পদে পদে সরকারের সমালোচনা করেছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সংসদের কার্যবিবরণীতে। জিয়াউর রহমানের আমলে গঠিত দ্বিতীয় সংসদে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাংসদ ছিলেন মাত্র ৩৯ জন। তাঁদের প্রতিবাদী ভূমিকায় অনেক সময় সরকারি দলকে বিচলিত হতে দেখেছি। এমনকি পঞ্চম ও সপ্তম সংসদের প্রথমদিকে যথাক্রমে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালাক্রমে কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা রাখতে চেষ্টা করেছে। পরবর্তীকালে সংসদের বাইরেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান খুঁজেছে।

সংসদে বিরোধী দল কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে না পারলে সেটি যেমন সরকারি দলের দায়, তেমনি বিরোধী দলের সাংসদেরা নির্বাচিত হয়েও যদি সংসদে না যান, তার পেছনের কারণটিও অনুসন্ধান করা জরুরি। বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। বিরোধী দল ছাড়া সংসদ হবে কী করে?

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]