জলবায়ু সম্মেলন সফল হয়েছে, হয়নি

গত ১ ডিসেম্বর জার্মানিতে পরিবেশসংগ্রামীরা কয়লাভিত্তিক জ্বালানি অবসানের দাবিতে সমবেত হন। ছবি: এএফপি
গত ১ ডিসেম্বর জার্মানিতে পরিবেশসংগ্রামীরা কয়লাভিত্তিক জ্বালানি অবসানের দাবিতে সমবেত হন। ছবি: এএফপি

বিজ্ঞানী ও পরিবেশ আন্দোলনকর্মীদের গভীর হতাশার মধ্যে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে বিজ্ঞান ও রাজনীতির ক্রমসম্প্রসারণশীল ব্যবধান নতুন বাঁক নিয়েছে। প্রায় ২০০টি দেশের সরকারি প্রতিনিধিরা জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন, অর্থাৎ কপ২৪ পোল্যান্ডের ক্যাটোভিস নগরীতে অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তাঁরা ২০২০ সাল থেকে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য নিয়মতান্ত্রিক কাঠামো তৈরির বিষয়ে আলোচনার নির্দিষ্ট সময়সীমা অতিক্রমের ৩০ ঘণ্টা পর গত ১৬ ডিসেম্বরে শেষ মুহূর্তে মুখ রক্ষা করার মতো একটি দুর্বল সমঝোতায় পৌঁছেছেন।

তাঁরা একটি দন্তবিহীন রুলবুক গ্রহণ করেছেন, যাতে কেবল নমনীয় সমস্যাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে, কঠিন বিষয়গুলো রেখে দেওয়া হয়েছে ভবিষ্যতে জাতিসংঘের দেনদরবারের জন্য। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চিলিতেসহ পরবর্তী দুটি কপ সম্মেলনের জন্য কয়েকটি মূল সমস্যা ও সিদ্ধান্ত ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তারপর ২০২০ সালে যুক্তরাজ্য বা ইতালিতে এ সম্মেলন আয়োজন করা হতে পারে।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বারবার হস্তক্ষেপের ফলে কপ২৪ সম্মেলন বিপর্যয় এড়াতে সক্ষম হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে জলবায়ু আলোচনাকারী হিসেবে আমি মনে করি, রুলবুক একটি দুর্বল প্রক্রিয়া, যাতে প্রয়োগের ঘাটতি রয়েছে। তবে আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে ইউএনএসজি একটি বিশেষ জলবায়ু সম্মেলন আহ্বান করেছে, যাতে কার্বন নির্গমনের পরিমাণ কমানোর লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তরণ ঘটানো যেতে পারে। পোলিশ নগরী ক্যাটোভিসে কপ২৪ সম্মেলনে অনেক বিজ্ঞানী সতর্ক করে দিয়েছেন, ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে কম, অর্থাৎ শিল্পবিপ্লবপূর্ব সময়ের মাত্রায় কমিয়ে আনতে হবে। অন্যথায়, বাংলাদেশের মতো অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশ, অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশ এবং ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলো ইতিমধ্যে গ্রাউন্ড জিরো অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও আরও প্রতিকূল প্রভাবের বিরাট ঝুঁকির অতলে হাবুডুবু খাবে। এর ফলে প্রতিবছর এসব দেশ অভিযোজনের বাইরে জলবায়ু-প্রভাবিত অভিবাসন এবং অর্থনৈতিক ও অ-অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণে জিডিপি ২ শতাংশেরও বেশি হারে হারাবে।

দীর্ঘদিন ধরে এলডিসি এবং জি-৭৭–এর জলবায়ু নেগোশিয়েটর হিসেবে আমি জানি যে আগামী দুই বছর জলবায়ু নেগোসিয়েটদের জন্য আরও কঠিন হবে। কারণ, তাদের কঠিন সমস্যার বিষয়ে আলোচনা করার এবং সমাধান করার জন্য প্রত্যেক সুযোগকে কাজে লাগাতে কঠিন লড়াই করতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষে আলোচনাকারী হিসেবে আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি মনে করি যে কপ২৪ আবার প্রমাণ করেছে, বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া এখনো জীবাশ্ম জ্বালানি স্বার্থ এবং তাদের অর্থে লালিত কিছু রাজনীতিবিদের হুমকি সত্ত্বেও কাজ করছে।

অনেকেই জানেন যে জাতিসংঘে অধিকাংশ সিদ্ধান্ত দীর্ঘ সময় এবং অনেক বিতর্কের পর গ্রহণ করা হয়। এমনকি সবচেয়ে ভালো সময়েও তা বেদনাদায়ক। কেন? কারণ, জাতিসংঘের কোনো অধিবেশনে প্রায় ২০০টি দেশের মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হয়ে। ক্যাটোভিসে প্রায় ১১ হাজার প্রতিনিধি সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক তথ্য এবং প্রস্তাবিত নীতি নিয়ে বিতর্কের জন্য দুই সপ্তাহ সময় নিয়েছেন। কিন্তু দেড় দিনের অতিরিক্ত সময় নিয়ে তাঁরা যখন রুলবুক সম্পর্কে সম্মত হয়েছেন, তখন বেশির ভাগ প্রতিনিধি সমাপনী অধিবেশন না দেখেই নিজ নিজ দেশে চলে গিয়েছেন। মতবিরোধের প্রায় ২ হাজার ৫০০ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে নেগোসিয়েটরদের বাহবা দেওয়া যায়। রুলবুক অনুযায়ী, নির্গমন হ্রাস করার বিষয়ে দেশগুলোকে এখন তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ এবং ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার জন্য প্যারিস চুক্তির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রতি দুই বছরে রিপোর্ট করতে হবে।

প্রশমনের ক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু অনেকগুলো বিষয় বিলম্বিত করা হয়েছে। যেমন জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদানগুলো (এনডিসি) সম্পর্কে সিদ্ধান্ত ২০২৪ সাল পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। ক্লিন ডেভেলপমেন্ট মেকানিজমসহ (সিডিএম) বাজারপদ্ধতির বিষয়ে সিদ্ধান্তগুলো কপ২৫ পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। গত কয়েক বছরে সিডিএম কর্মসূচি স্থাপনে সক্ষম হওয়ার পরে আফ্রিকা ও এলডিসি কোনো ভারী বোঝা বহন না করেই অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিল। অভিযোজন করের ওপর আলোচনার বিষয় ছিল এটি ধারা ৬.৪, নাকি সব প্রক্রিয়ার ভিত্তিতেই হবে তা নির্ধারণ করা। শিল্পোন্নত দেশগুলো এর বিরুদ্ধে। অন্যদিকে, ব্রাজিল, আফ্রিকা এবং ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জোট পক্ষে ছিল। অভিযোজন যোগাযোগ নমনীয় হওয়া উচিত, এটি দেশের তুলনা করার জন্য ব্যবহারযোগ্য নয়, পর্যালোচনার বিষয় নয় এবং আর্টিকেল ১৩ অনুসারে অভিযোজন প্রতিবেদনে যুক্ত করা যেতে পারে।

অর্থায়নের বিষয়ে সামান্য অগ্রগতি হয়েছে। তারা সম্মত হয়েছেন যে এক্স-অ্যান্টি কমিউনিকেশন (ধারা ৯.৫) প্রযোজ্য হবে শিল্পায়িত দেশগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক। অন্য সবার জন্য হবে স্বেচ্ছামূলক। ক্যাটোভিস সম্মেলনে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঐতিহাসিক বিভক্তি কোনো বড় সমস্যা ছিল না। অতীতের বাধাগুলো অতিক্রম করা গেছে। চীন স্বচ্ছতার মানগুলোর বিষয়ে সম্মত হয়েছে। উন্নত দেশগুলো, বিশেষ করে জার্মানি ও নরওয়ে দরিদ্র দেশগুলোর পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি অঙ্গীকার করেছিল।

তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও সৌদি আরব শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয়ে বৈজ্ঞানিক সতর্কতা অবলম্বন করার বিষয়টি নাকচ করার চেষ্টা চালিয়েছে। কার্বন ট্যাক্স বা জীবাশ্ম জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সামাজিক প্রভাবও আলোচনায় এসেছিল। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ নিকোলাস স্টার্ন ও ওটমার এডেনহফার যুক্তি দেন যে কার্বন ট্যাক্স এখনো জীবাশ্ম জ্বালানিবহির্ভূত অর্থনীতিগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। তবে এই পর্যায় ন্যায্য ও দ্রুত হতে হবে। অর্থাৎ সবুজ অবকাঠামোর জন্য অতিরিক্ত কর আরোপ বা সমাজের দরিদ্র সদস্যদের মধ্যে এটি পুনরায় বিতরণ করা যেতে পারে। স্বল্প সময়ে অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রভাব প্রশমনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাড়ানো, অভিযোজন বাড়ানো এবং অর্থনৈতিক ও অ-অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতির দিকে নজর দেওয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, আগামী দুই বছরে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অবকাঠামোর ক্ষেত্রে নীতিমালা ও বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ৪৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে কি না, তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

আমি আন্তরিকভাবে আশা করি, নতুন এলডিসি চেয়ার ভুটানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও অন্যান্য এলডিসি আগামী দুই বছরে ৪৮টি দেশের এই গ্রুপকে প্রস্তুত করতে কোনো সুযোগ ছাড়বে না। সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে তাদের হোমওয়ার্ক করতে হবে। প্রতিকূল জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ একটি গ্রাউন্ড-জিরো দেশ হিসেবে নিজের কোনো দোষ ছাড়াই জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার। এ বিষয় সম্পর্কে তার বিবরণে পরিবর্তন আনতে হবে।

২০০৮ সালে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান (বিসিসিএসএএপি) প্রণয়ন করে। ২০০৯ সালে তা সংশোধন করেছে। এমন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রথম দেশ বাংলাদেশ। এটি এখন অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে আপডেট করা উচিত, যাতে আর কোনো বিলম্ব ছাড়াই এটি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের দ্বারা প্রণীত এনএপি রোডম্যাপ অনুসরণ করে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (এনএপি) অবিলম্বে প্রণয়ন করা উচিত। এখানেও মানুষের অংশগ্রহণ বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। বাংলাদেশ নিজস্ব বাজেটে জলবায়ু ট্রাস্ট তহবিল এবং বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের এবং কয়েকটি দেশসহ উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় জলবায়ু রেসিলিয়েন্ট ফান্ড তৈরি করেছে। এখন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করার জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড, অ্যাডাপ্টেশন ফান্ড, এলডিসি ফান্ড এবং অন্য বৈশ্বিক তহবিলগুলো থেকে অর্থায়ন পাওয়ার জন্য অভিযোজন ও প্রশমন কর্মসূচিগুলো প্রণয়ন ও পরিচালনার জন্য দক্ষতা ও সক্ষমতা তৈরি করা জরুরি প্রয়োজন।

কামরুল ইসলাম চৌধুরী: জলবায়ু, পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, জাতিসংঘের কিয়োটো প্রোটোকলের যুগ্ম বাস্তবায়ন সুপারভাইজারি কমিটির সাবেক চেয়ার এবং জাতিসংঘের অ্যাডাপ্টেশন কমিটির সাবেক সদস্য।
[email protected]