কৃষকদের বিদ্রোহ

শশী থারুর। ফাইল ছবি
শশী থারুর। ফাইল ছবি

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) যখন ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় পেয়েছিল, তখন তিনি ভারতের সব ভোটারকে ‘আচ্ছে দিন’ এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এসব ভোটারের মধ্যে দেশের কৃষকেরাও ছিলেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ২০২০ সালের মধ্যে তাঁদের আয় দ্বিগুণ করে দেবেন। সেই প্রতিশ্রুতি যে পূরণ হয়নি, সে তো দেখাই যাচ্ছে।

ভারতের কৃষি খাত এখন গভীর সংকটে। কৃষকেরা ক্ষুব্ধ। নরেন্দ্র মোদির গত পাঁচ বছরের শাসনামলে কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত সরঞ্জামের দাম অনেক বাড়ার ফলে চাষাবাদের খরচও বেড়ে যায়। ফলে কৃষকেরা ঋণ নিতে বাধ্য হন। কিন্তু উৎপাদিত ফসল ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে না পারায় তাঁরা ঋণও শোধ করতে পারেননি। সরকার-প্রতিশ্রুত সহায়তাও তাঁরা পাননি। চড়া সুদে ঋণ নিয়ে তা শোধ করতে না পেরে ২০১৬ সালে গোটা ভারতে ১১ হাজার ৪০০ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। ফলে সারা দেশের কৃষকেরা এখন মোদি সরকারের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ।

বিজেপি সরকার কৃষি খাতকে অবহেলা করার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দেশের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা। এ ছাড়া ভূমিহীন কৃষিশ্রমিকেরাও মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ২০১৬ সালের নভেম্বরে মোদির বিবেচনাহীন ও হঠকারিতাপূর্ণ নোটবন্দী প্রকল্পের (১০০০ ও ৫০০ রুপির নোট বাতিল) ফলে তাঁরা একেবারে পথে বসে যান। যেহেতু তাঁদের মজুরি দেওয়া হতো নগদ অর্থে, নোটবন্দীর ফলে তা আর সম্ভব হচ্ছিল না। আবার বাতিল হওয়া ১০০০ ও ৫০০ রুপির নোটের পরিবর্তে যে নোট দেওয়ার কথা ছিল, তা যথেষ্ট পরিমাণে ছাপানো হয়নি। ফলে লাখ লাখ কৃষিশ্রমিক তখন কাজ হারান। এ ছাড়া ছোট ও মাঝারি শিল্পের এত ক্ষতি হয়েছে যে সেই ক্ষতি এখনো পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।

নরেন্দ্র মোদি আগের সরকারের চালু করা মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিম (এমজিএনআরইজিএস) নিয়েও গন্ডগোল পাকিয়েছেন। এটি একটি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প, যা দেশের গ্রামীণ শ্রমিকদের কর্মসংস্থান ও জীবিকা নির্বাহের সুযোগ করে দেয়। প্রকল্পটি প্রতিটি গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারকে প্রতি আর্থিক বছরের ১০০ দিন ন্যূনতম কাজের নিশ্চয়তা প্রদান করে। এই প্রকল্প গ্রামের দরিদ্র মানুষের কেনার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করেছে এবং গ্রামের লোকদের কাজের সন্ধানে শহরে আসার পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এই প্রকল্পের অর্থছাড়ের বিলগুলো বিজেপি সরকার সময়মতো অনুমোদন না করায় বহু গ্রামীণ শ্রমিক বেশ কয়েক মাস ধরে কোনো টাকা পাননি।

মোদি সরকারের ক্রমাগত ব্যর্থতার কারণে ভারতের কৃষকেরা আজ চরমভাবে হতাশ। আর এ কারণে তাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন, কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করছেন তাঁদের কথা শুনতে।

২০১৭ সালে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর বিক্ষুব্ধ কৃষকেরা রাজধানী নয়াদিল্লিতে গিয়ে ১০০ দিনের বেশি সময় ধরে বিক্ষোভ করেছেন। এ সময় অনেক কৃষক তাঁদের পরনের কাপড় ছুড়ে ফেলে দিয়ে দেখিয়েছেন যে এ ছাড়া তাঁদের কাছে আর কিছু নেই। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে বিজেপিনিয়ন্ত্রিত রাজ্য মহারাষ্ট্রে প্রায় ২৫ হাজার কৃষক ঋণ মওকুফ, তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য এবং ভূমির অধিকার দাবিতে মিছিল বের করেন। গত নভেম্বর মাসে একই রাজ্যে খরার কারণে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবিতে প্রায় ২০ হাজার কৃষক বিক্ষোভ করেন।

নভেম্বরের শেষ দুই দিনে সারা দেশ থেকে এক লাখের বেশি কৃষক রাজধানী নয়াদিল্লিতে বিক্ষোভ দেখান। তাঁরা ঋণ মওকুফের পাশাপাশি কৃষকদের দুরবস্থা নিয়ে সংসদে জরুরি অধিবেশন ডাকার দাবি জানান। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে সংসদের সাম্প্রতিক অধিবেশনগুলোতে কৃষকদের সংকট নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়েছে এবং তাঁদের সংকট নিরসনে কোনো প্রস্তাব জমা দিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।

কৃষকদের এই বিক্ষোভের মুখে মোদি সরকার ঠিক কী করবে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া না গেলেও এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রচারণায় বিজেপিবিরোধী জোট দলটির ব্যর্থতার বিষয়টিকেই বড় করে তুলে ধরবে। ভারতের তিনটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস জয়লাভ করার পর কৃষকদের ঋণ মওকুফসহ নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

তবে ঋণ মওকুফই একমাত্র সমাধান নয়। ভারতের কৃষকদের মূল সমস্যাকে চিহ্নিত করতে হবে। কৃষি বিষয়ে সরকারের নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। আগামী নির্বাচনে যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের দেশের কৃষির বিষয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত

শশী থারুর: ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী