ভারত থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন কেন

ভারত থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের আশঙ্কা ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হতে শুরু করেছে
ভারত থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের আশঙ্কা ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হতে শুরু করেছে

গত দুই সপ্তাহে ভারত থেকে কমপক্ষে ১ হাজার ৩০০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে ঢুকেছে। এরা বিভিন্ন সময়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু এখন তাদের সেখান থেকে বাংলাদেশে চলে আসতে কার্যত বাধ্য করা হয়েছে। সীমান্তে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি) তাদের আটক করে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পাঠিয়ে দিয়েছে বলে বার্তা সংস্থাগুলোর খবরে জানা গেছে। কিন্তু তাদের ভারত থেকে বিতাড়ন, বিশেষত বাংলাদেশে পাঠানো নিয়ে বাংলাদেশ সরকার কোনো মন্তব্য করেনি; প্রতিবাদ করার লক্ষণও নেই। আপাতদৃষ্টে ছোট ঘটনা বা সংখ্যার বিবেচনায় ক্ষুদ্র বলে মনে হলেও এটি ভারতের একটি নীতির ফসল এবং তা ভবিষ্যতে আরও বড় আকার নেওয়ার ইঙ্গিতবাহী।

গত অক্টোবরে যখন ভারত সাত রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ বলে মিয়ানমারে ফেরত পাঠায়, তখন তাদের নিরাপত্তা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আপত্তি ও সমালোচনা ভারত সরকার ধর্তব্যে নেয়নি। মানবাধিকার সংগঠনগুলো ও গবেষকেরা আশঙ্কা করেছিলেন, ভারত সরকার রোহিঙ্গাদের যেভাবেই হোক ভারত থেকে বহিষ্কার করার পথেই এগোচ্ছে। সাতজনকে মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তরের ঘটনাকে তাঁরা এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করেছিলেন।

ভারত যে সাত রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমারের হাতে তুলে দেয়, তারা ‘অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের’ অভিযোগে ২০১২ সাল থেকে আসামের শিলচর কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিল। এ বছর ৪ জানুয়ারি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানায়, অভিবাসনপ্রত্যাশী একটি পরিবার ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে ভারতে নিবন্ধিত হওয়া সত্ত্বেও তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। পরিবারটি ২০১৩ সালে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের অভিযোগে আসামে আটক হয় এবং নির্দিষ্ট সময় কারাবাস শেষে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়। এই নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভারতীয় দপ্তর থেকে নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

২০১৭ সালের আগস্ট মাসে সরকার সব বিদেশি বিতাড়ন, এমনকি যারা শরণার্থী বলে নিবন্ধিত, তাদেরও বের করে দেওয়ার কথা বলে। ২০১৮ সালের অক্টোবরের ঘটনার পরে আশঙ্কা করা হচ্ছিল এক বছর ধরে ভারতে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন বিজেপি ও সরকারি কর্মকর্তারা হুমকি দিয়ে আসছিলেন যে তাদের ভারত থেকে বিতাড়ন করা হবে, তার কাজ শুরু হচ্ছে। জানুয়ারিতে শুধু একটি পরিবারকে ফেরত পাঠালেও তা যে বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, তা বোঝা যাচ্ছিল। গত দুই সপ্তাহের ঘটনাবলি প্রমাণ করে যে ভারত থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের আশঙ্কা এখন ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হতে শুরু করেছে।

ভারতে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে বলে বলা হয়ে থাকে, যাদের মধ্যে সাড়ে ১৬ হাজার জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তালিকাভুক্ত। ভারত সরকার দাবি করে, রোহিঙ্গারা সারা ভারতেই ছড়িয়ে আছে। এক হিসাব অনুযায়ী, ৭ হাজার ৯৬ জন রোহিঙ্গা আছে জম্মু-কাশ্মীরে, ৩ হাজার ৫৯ জন আছে হায়দরাবাদে, ১ হাজার ১১৪ জন আছে হরিয়ানায়, ১ হাজার ২০০ জন আছে পশ্চিম-উত্তর প্রদেশে, ১ হাজার ৬১ জন দিল্লিতে এবং ৪০০ জন রাজস্থানে ৷ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার গত বছরের জুন মাসে জম্মু-কাশ্মীরসহ বিভিন্ন রাজ্যকে এই মর্মে নির্দেশ পাঠিয়েছিল যে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা’দের রাখতে হবে রাজ্যগুলোর এখতিয়ারভুক্ত পূর্বনির্ধারিত শিবিরে। তাদের বায়োমেট্রিক তথ্যসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য তালিকাভুক্ত করতে এবং তাদের কোনো ধরনের পরিচয়পত্র না দেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। এসব পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আপত্তি উঠেছিল এই কারণে যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যাপারে এসব নির্দেশ ছিল বৈষম্যমূলক। কেননা ভারতে অন্য যেসব শরণার্থী আছে, যেমন তিব্বত থেকে পালিয়ে আসা বৌদ্ধ শরণার্থী, তাদের ব্যাপারে এই ধরনের কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি। এই বৈষম্য যে ধর্মভিত্তিক, তা সহজেই বোঝা যায়।

ধর্মভিত্তিক বৈষম্য, বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে পরিচালিত ব্যবস্থাদি, এখন ভারতের মোদি সরকার কোনো রকম রাখঢাক না করেই করছে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এত দিন ধরে সমাজে যে মুসলিমবিদ্বেষ ছড়িয়েছে, তা এখন আরও বেশি খোলামেলাভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি রূপ নিচ্ছে। তার সাম্প্রতিক উদাহরণ লোকসভায় পাস হওয়া নাগরিকত্ব আইন (সংশোধনী) বিল। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে যে নতুন নাগরিকত্ব বিল তৈরি করা হয়েছে, তাতে ২০১৪ সালের আগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের কারাবন্দী বা বিতাড়নের বদলে এমন ব্যবস্থা করা হবে, যাতে তারা ভারতে ছয় বছর বসবাসের পর স্থায়ী নাগরিকত্ব পাবে। এই নিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে, বিশেষ করে আসামে বিজেপির সঙ্গে তার অনেক দিনের মিত্র অসম গণপরিষদের মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে।

অসম গণপরিষদ মনে করে, এতে করে বাংলাভাষী হিন্দুধর্মাবলম্বীরা আসামে জায়গা পাবে। এ বিষয়ে আল-জাজিরায় প্রকাশিত এক সংবাদ বিশ্লেষণে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি বিভাগের অধ্যাপক অপূর্বানন্দ যথার্থভাবেই বলেছেন, বিলটি আসলে ভারতকে ‘হিন্দু রাষ্ট্রে’ রূপান্তর করার জন্য বিজেপির বৃহত্তর মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ। ভবিষ্যতে যদি বিলটি রাজ্যসভায় পাস হয়, তবে তা শুধু ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দ্বন্দ্বের সৃষ্টিই করবে না, বরং ভারতে চলমান হিন্দুকরণ প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।

গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচনের বড় তিনটিতেই বিপর্যয় এবং এই বছরের মার্চ-এপ্রিলে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে পরাজয়ের আশঙ্কায় ক্ষমতাসীন বিজেপি একাদিক্রমে তার হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা আরও বেশি করে সামনে আনতে শুরু করেছে এবং বিদেশিভীতিকে (জেনোফোবিয়া) উৎসাহিত করছে। হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডার মুখ্য বিষয় হচ্ছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার সমর্থকদের উত্তেজিত করে তোলা, যার উদাহরণ নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী বিল। পাশাপাশি আসামের নাগরিকত্ব তালিকা থেকে যে ৪০ লাখ লোককে বাদ দেওয়া হয়েছে, তাদের অধিকাংশই মুসলমান। এতে করে একই সঙ্গে বিদেশিভীতি এবং মুসলিমভীতির দুই উদ্দেশ্যই হাসিল করা সম্ভব। রোহিঙ্গাদের বিতাড়নও আসলে এই অ্যাজেন্ডারই অংশ।

রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের ক্ষেত্রে ভারতের আরেকটি বিবেচনা হচ্ছে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করা। এ ক্ষেত্রে ভারত-মিয়ানমারের সমঝোতা হচ্ছে আসলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভারতের সমঝোতা (শুভজ্যোতি ঘোষ, ‘ভারত কীভাবে সে দেশে থাকা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে পারছে?’ বিবিসি, ৩১ অক্টোবর ২০১৮)। এতে করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, যার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ আছে, একধরনের গ্রহণযোগ্যতা লাভ করছে। মিয়ানমার সরকার দেখাতে চাইছে যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে তার আগ্রহের অভাব নেই; বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের না যাওয়ার দায় তারা বাংলাদেশের ওপরে চাপিয়ে দিতে চাইছে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে গ্রহণযোগ্যতা দেওয়া এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে দীর্ঘসূত্রতা বিষয়ে পরোক্ষভাবে মিয়ানমারের যুক্তিকে সাহায্য করা কোনোটাই বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূলে নয়। রোহিঙ্গা সংকটে ভারত যে কেবল মিয়ানমারের পক্ষেই দাঁড়িয়েছে তা নয়, এখন মিয়ানমারের সঙ্গে এই বিষয়ে সমঝোতা এবং রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে যে আচরণ করছে, তা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধীও বটে। নাগরিকত্বের প্রশ্ন যেকোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, কিন্তু আসামে ৪০ লাখ বাংলাভাষী নাগরিককে কার্যত অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা বাংলাদেশের জন্য একটা হুমকি। এখন এই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কাজ একধরনের চাপ সৃষ্টিও বটে।

ভারতের রাজনৈতিক সমর্থনের ওপরে নির্ভরতার কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে প্রতিবাদ আশা করা খুব বেশি বিবেচকের কাজ হবে না। তদুপরি সম্ভবত ‘বিস্ময়কর’ নির্বাচনে ‘অভূতপূর্ব’ বিজয় উদ্‌যাপনও একটি কারণ। কিন্তু এই বিষয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দল বা সিভিল সোসাইটির নীরবতা লক্ষণীয়। মানবিক ও রাজনৈতিক—উভয় বিবেচনায়ই ভারতে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিতাড়ন এবং বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার বিরুদ্ধে এখনই অবস্থান নেওয়া দরকার।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর