এই 'মহামিথ্যা' থেকে মুক্তি কোথায়?

হাজার শব্দের থেকে একটি স্থিরচিত্রই অনেক বেশি মুখর হতে পারে। কিন্তু এই প্রযুক্তির যুগে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে অডিও বা ভিডিওকে অস্বীকার করতে পারবে কে? বিশেষ করে দলজীবীদের এ যুগে যখন প্রায় প্রতিটি মানুষ যেকোনো ঘটনায় পৃথক কুয়ায় অবস্থান নিতে অভ্যস্ত, তখন সবকিছুতেই প্রমাণ প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

এ ক্ষেত্রে অডিও ও ভিডিও বড় প্রমাণ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ, এর মাধ্যমে ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার সুযোগ অবারিত হয়। ফলে, কোনো ঘটনার সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য ব্যক্তিকে আর কারও কাছে ছুটতে হয় না। আর স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে এই ‘সত্য’ প্রচারের ক্ষমতাও এখন সাধারণ মানুষের হাতে। ফলে, বর্তমান সময়ের মানুষ তার চোখ ও কানকে প্রায় অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত করতে পারছে। আর এই ক্ষমতাতেই লুকিয়ে রয়েছে সবচেয়ে বড় বিপদটি।

বর্তমান বিশ্ব ভীষণ রকম অস্থির। যুক্তরাষ্ট্রে চলছে অচলাবস্থা। তুরস্ক হুমকি দিচ্ছে কুর্দিদের। ইরানে আক্রমণের পথ খুঁজতে পেন্টাগনকে অনুরোধ করেছে হোয়াইট হাউস। ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিলসহ দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো আক্ষরিক অর্থেই ফুটন্ত কড়াইয়ের ওপর। রয়েছে চিরায়ত টলায়মান আফ্রিকা। যুক্তরাষ্ট্রের পর কানাডার সঙ্গে বিবাদ শুরু হয়েছে চীনের। মধ্যপ্রাচ্য বরাবরের মতোই অস্থিতিশীল, যেখানে সিরিয়াকে কেন্দ্র করে প্রভাব বিস্তারের নতুন ছক আঁকছে রাশিয়া। শান্তি আলোচনা এখনো কোনো দিশা পায়নি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো দেখছে ‘স্ট্রংম্যান’-এর শাসন, নামকাওয়াস্তের নির্বাচন।

এ-ই যখন অবস্থা, তখন ভাবা যাক, ফাঁস হয়ে গেল ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত উপদেষ্টার আলোচনার ভিডিও, যেখানে তাঁরা কোনো গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা করছেন। ধরা যাক, এমন কিছুই নয়—ঘরোয়া আড্ডায় বসে কেউ করছেন অন্য কোনো নেতার কঠোর সমালোচনা। কিংবা কোনো ধর্মীয় কট্টরবাদী রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ল ধর্মীয় অবমাননার কোনো ভিডিও। বলার অপেক্ষা রাখে না, এমনটি হলে তার প্রভাব কখনো কখনো দেশ-কাল-পাত্র, সব বিবেচনা হারিয়ে ফেলে। ভুক্তভোগী হয় অগণিত সাধারণ মানুষ। এ দেশেও তো এমন উদাহরণ রয়েছে ভূরি ভূরি। কিন্তু এবার যদি একটু ভাবা যায় যে প্রযুক্তি কোথায় গেল, তবে স্তব্ধ হতে হয়। কারণ, শুধু অডিও ও ভিডিও রেকর্ডিংয়ের প্রযুক্তি উদ্ভাবনেই প্রযুক্তি থেমে থাকেনি, এসবকে ইচ্ছেমতো গড়ে নেওয়ার অজস্র পন্থাও উদ্ভাবিত হয়েছে। এটা এতটাই যে সত্য-মিথ্যার প্রভেদ করাটা দুরূহ হয়ে পড়ে।

এ দারুণ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পর তা নিশ্চিতভাবেই থেমে থাকেনি। হরদম ব্যবহার হচ্ছে। তৈরি করছে এক ‘মহামিথ্যা’। এই ‘মহামিথ্যা’ নির্মাণ করছে এক ‘মহামায়া’র, যার জগতে ঢুকে বসে আছি আমরা সবাই। এই জগতে বসে এমন অনেক তথ্যই এখন আমাদের উত্তেজিত করছে, বেদনার্ত করছে, ক্রুদ্ধ করছে, যার কোনো অস্তিত্বই হয়তো নেই। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বলা হতবুদ্ধিকর এমন সব কথার অডিও-ভিডিও আমাদের সামনে ঘুরছে, যা হয়তো তাঁরা কখনোই বলেননি। এই ‘মহামায়া’র নির্মাণক্ষেত্রটি প্রধানত রাজনৈতিক। রাজনীতিক ছাড়া কথার খেলা আর কার কাছে এত মূল্যবান। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেই এ ‘মহামিথ্যা’ ব্যবহৃত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এটা সত্য যে ভুয়া তথ্যের প্রচার অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমান সময়ের মতো এত বল্গাহীন অবস্থার সৃষ্টি সম্ভবত আগে কখনোই দেখা যায়নি। এই সময়ে যে-কেউ চাইলে, যে-কারও নামে যা কিছু বলে দিতে পারে। বিতর্ক তুলতে যে-কারও ঠোঁটে জুড়ে দিতে পারে যেকোনো কথা।

এই মহামিথ্যা নবোউদ্যমে যাত্রা শুরু করেছে মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপ্রযুক্তির অগ্রগতির হাত ধরে। আরও ভালো করে বললে বলতে হয় ‘ডিপ লার্নিং’-এর অগ্রগতিই এই মহামিথ্যার জন্মপ্রক্রিয়া সহজ করে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ‘নিউরাল নেটওয়ার্কস’ নামের একধরনের অ্যালগারিদম ব্যবহার করা হয়, যার মূল কাজ হচ্ছে অন্তর্নিহিত নিয়ম ও কোনো কিছুকে অনুকরণ করার দক্ষতা অর্জন। গুগল তার সার্চ ইঞ্জিনের দক্ষতা বাড়াতে এই প্রযুক্তিই ব্যবহার করে। এই প্রযুক্তি যে-কেউ চাইলে কিনে নিতে পারেন। আবার বিনা মূল্যেও মিলতে পারে। প্রযুক্তির কালোবাজারে পাওয়া যায় এর আধুনিকতম সংস্করণও। ফলে, বাধা ছাড়াই যে-কেউ চাইলে নিজের মতো করে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে। শুধু চাই একটু প্রশিক্ষণ। শুরুতে এটি বিখ্যাত মানুষদের প্রতিকৃতি ব্যবহার করে শিক্ষণীয় ভিডিও নির্মাণে ব্যবহার করা হয়। এটিই এই প্রযুক্তির সবচেয়ে ইতিবাচক ব্যবহার। ক্রমে এটি পর্নোগ্রাফি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে নিজের উপযোগ তৈরি করেছে। আর এখন এর সবচেয়ে বেশি ভোক্তা সম্ভবত রাজনীতির প্রাঙ্গণে। এটি ব্যবহার করে অনায়াসে সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়া যায়, রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করা যায়, এমনকি নির্বাচনে জয়ের পথও নির্মাণ করা যায় অনায়াসে। এমনকি কখনো কখনো প্রচলিত গণমাধ্যমকেও রীতিমতো বোকা বনে যেতে দেখা যায় এই ‘মহামায়া’র কাছে।

গত শতকজুড়ে মানুষের কাছে খবরাখবর পৌঁছানোর মাধ্যম বলতে ছিল সংবাদপত্র, টেলিভিশন, বেতার ও সাময়িকীপত্র। সাংবাদিকেরা ভিত্তিহীন তথ্যের প্রবাহ রুখতে নিজেদের মধ্যে কিছু মান নির্ধারণ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এই কাঠামো ভেঙে দিয়েছে। ইন্টারনেটের সম্প্রসারণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রসারের কারণে ‘তথ্যের’ সওদাগরদের রীতিমতো বিপাকে পড়তে হয়েছে। গত এক দশকে এটি এতটাই সম্প্রসারিত হয়েছে যে তা সাধারণ মানুষকে তথ্যের কর্তৃত্ব নেওয়ার ইতিবাচক একটি জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছিল। কিন্তু বিপত্তিটা বাধাল এই ‘মহামিথ্যা’। তথ্যের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল প্রজন্মের সামনে এই ‘মহামিথ্যা’ই মহাসত্য হিসেবে আবির্ভূত হতে থাকল। আবার সুযোগ থাকায় এই ‘মহাসত্য’ আর এক স্থানে আটকে থাকে না। কোনো যাচাই ছাড়াই তা ছুটতে শুরু করে দরজায় দরজায়, কড়া নেড়ে বলে, ‘আমাকে শোনো, দেখো কী হয়েছে, হচ্ছে।’

শাসক থেকে শুরু করে শাসিত—এই ‘মহামিথ্যা’র সুযোগ নিয়ে মহামায়ার নির্মাণ করতে পারে যে-কেউ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ঘায়েলের পাশাপাশি মিথ্যার প্রমাণ দেখিয়ে সত্যেরও মুখ বন্ধ করার সুযোগ নিতে পারে শাসকেরা। বিশেষত, যখন কোনো দেশের শাসক কট্টর হয়, তখন নিজের সমালোচনার রাস্তা বন্ধ করতে শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার কথা বলে ‘মিথ্যা তথ্য রোধের’ অজুহাতে সত্যেরই গলা টিপে ধরার আশঙ্কা বাড়ে। এই ‘মহামিথ্যা’ এমন এক সময়ের নির্মাণ করে, যখন সবকিছু নিয়েই মানুষ সংশয়ে ভোগে।

ফরেন অ্যাফেয়ার্সের তথ্যমতে, ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের এমনই এক সংশয়ের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ফল হিসেবে সেখানে এসেছে বিভক্তি। রিপাবলিকান ভোটাররা ভাবছে, ‘তাহলে আমরা জেতাইনি ট্রাম্পকে?’ আবার ডেমোক্র্যাট ভোটাররা বলছে, ‘দেখো কী ষড়যন্ত্র!’ আদতে দুই গোত্রই এই ‘মহামায়ার’ কাছে দারুণভাবে অপমানিত।

ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল ২০১৭ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়। বর্তমান প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা কিছু নথি প্রকাশের চেষ্টা করেছিল সেই সময় কিছু রুশ হ্যাকার। বলা হয় যে ব্রেক্সিট নিয়ে উত্তাল যুক্তরাজ্যের যন্ত্রণার কেন্দ্রেও রয়েছে এই ‘মহামায়া’ই। তবে সব দেশে এর বিস্তৃতি সমান নয়। কারণ, বহু দেশেই দখল-টখল করে ‘নিপাট মিথ্যাতে’ই এখনো বেশ কাজ চলে যাচ্ছে। প্রযুক্তির অত কারিকুরি তেমন প্রয়োজন পড়ছে না। তবে থেমে নেই তারাও। নির্বাচনে দরকার না পড়লেও বিরোধীপক্ষের চরিত্র হননে কিংবা তাকে বিতর্কিত করতে এ পন্থার শরণ নিচ্ছে প্রায় সবাই।

তবে বিষয়টি আর বেশি দিন এই একই মাত্রায় কাজ করবে বলে মনে হয় না। কারণ, বারবার ব্যবহারে আবেদন হারিয়ে ফেলতে পারে। এরই মধ্যে মানুষ এতটাই সংশয়ী হয়ে উঠেছে যে, কাউকে বিতর্কিত করতে বাজারে ছেড়ে দেওয়া অডিও-ভিডিও ক্লিপ হয়তো ওই নেতাকে আরও নিপীড়িত হিসেবেই সবার সামনে তুলে ধরবে।

এই ‘মহামিথ্যা’ কোনো সীমানা মানছে না। ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। এক দেশ আরেক দেশকে ঘায়েল করতে, কিংবা বিশ্ব নেতৃত্ব নিজের আয়ত্তে রাখতে বিবদমান পক্ষগুলো হরদম ব্যবহার করছে এই পন্থা। জিওপলিটিকা ডটআরইউ জানাচ্ছে, দেড় দশক আগেই ইরাক যুদ্ধ নিয়ে এ ধরনের অজস্র ভিডিও ছাড়া হয়েছিল, যা নির্মাণ করেছিল যুক্তরাজ্যের কোম্পানি বেল পোটিঙ্গার। পেন্টাগন এ জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে দিয়েছিল ৫০ কোটি ডলার। এই উদাহরণ থেকেই বর্তমান অবস্থাটি সহজে অনুমেয়। সৌদি জোটের সঙ্গে কাতারের কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে এমন বহু অডিও-ভিডিও, যা পশ্চিমাদের সমর্থন আদায়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমন অজস্র উদাহরণ দেওয়া সম্ভব।

মোদ্দাকথা, এই ‘মহামিথ্যা’ এমন এক সংকটকে ঘনিয়ে তুলছে, যা ভেতর ও বাহির দুটিকেই সংশয়ে ফেলে দিচ্ছে। পাল্টা প্রযুক্তি দিয়ে ‘মিথ্যা’ নির্ণয়ের সমাধানও হাজির হয়েছে। কিন্তু সংকট হচ্ছে এই পাল্টা প্রযুক্তি রয়েছে সীমিত মানুষের হাতে। এই প্রযুক্তি নিয়েও তো রয়েছে সংশয়। তাই এ সংকট থেকে বেরোতে মানুষকে মানুষের ওপর পুনরায় আস্থা স্থাপন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।