শ্রমিকদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ

তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকদের তরফ থেকে অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এক সপ্তাহের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের মজুরিকাঠামো সমন্বয় করার পর যখন আন্দোলন থেমেছে, তখন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকদের ওপর পাল্টা আঘাত শুরু হয়েছে। বিভিন্ন পোশাক কারখানার কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে চুরি, ভাঙচুর, মারধর, কারখানার ক্ষতিসাধন, হুমকি প্রদান ইত্যাদি অভিযোগে মামলা করছে। ইতিমধ্যে প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিককে এসব মামলার আসামি করা হয়েছে। পুলিশ ২০ জন শ্রমিককে গ্রেপ্তারও করেছে, অনেক শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। মামলার আসামি হিসেবে যেসব শ্রমিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের প্রায় সবাইকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এই চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী আছেন। যেসব অপরাধের অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, সেগুলো এই নারী শ্রমিকেরা করেছেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। মামলাগুলো যে হয়রানিমূলক, তা স্পষ্টতই অনুমান করা যায়। এটা শুধু অন্যায় আচরণ নয়, খোদ পোশাকশিল্পের জন্যই আত্মঘাতী অপকৌশল।

এসব স্পষ্টতই প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ, এর পরিণতি তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে। তৈরি পোশাকশিল্পের যেসব মালিক শ্রমিকদের দমনের উদ্দেশ্যে মামলা দায়ের ও চাকরিচ্যুতির অপকৌশল বেছে নিয়েছেন, তাঁরা যদি ভেবে থাকেন যে এই পন্থায় ভয় পাইয়ে শ্রমিকদের আন্দোলন করার প্রবণতা রোধ করা সম্ভব, তাহলে তাঁদের শুধু ভুলই হবে না, অন্যায়ও হবে। কারণ, শ্রমিকদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করার অধিকার আছে। যুক্তিসংগত দাবিতে শান্তিপূর্ণ পন্থায় আন্দোলন করার অধিকার খর্ব করা হলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে সময়ে সময়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় শ্রমিকদের বঞ্চনা থেকে সৃষ্ট অসন্তোষের কারণে। তাঁদের বঞ্চনা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হলে অসন্তোষের কারণ থাকে না। কিন্তু তা না করে অসন্তোষ অগ্রাহ্য করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়; সেটা কখনোই সুফল দেয়নি। বরং মালিকেরা যখন যুক্তিবুদ্ধি ও বিবেচনাবোধের পরিচয় দিয়েছেন, শ্রমিকদের দাবিদাওয়াগুলো আংশিকভাবে হলেও পূরণের উদ্যোগ নিয়েছেন, তখন পোশাকশিল্পে শান্তি ও স্থিতিশীলতা লক্ষ করা গেছে।

যেকোনো শ্রমঘন শিল্পের নির্বিঘ্ন উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করতে হলে স্থায়ী স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। সে জন্য শ্রমিকদের সন্তোষের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখা উচিত। কোনো শিল্পের শ্রমিকেরা অবিরাম বঞ্চনাবোধ ও অসন্তোষের মধ্যে থাকলে সে শিল্পের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঝুঁকি ক্রমেই বাড়তে থাকে। আমাদের তৈরি পোশাকশিল্প তেমনই একটি শিল্প, তার নাজুকতা মাঝেমধ্যেই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এটা স্থায়ীভাবে দূর করা প্রয়োজন, সে জন্য মালিক–শ্রমিক সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। এই দুই পক্ষের পরস্পরকে প্রতিপক্ষ ভাবার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শ্রমিকদের পেশাসংক্রান্ত অভাব–অভিযোগ, সুবিধা–অসুবিধা, দাবিদাওয়ার কথা মালিকদের মন দিয়ে শোনার ও বিবেচনা করার মানসিকতা থাকতে হবে। শ্রমিকদের সব আইনসম্মত অধিকার ভোগের সঙ্গে মালিকদের স্বার্থের কোনো বৈপরীত্য নেই; বরং শ্রমিক ভালো থাকলে শিল্পেরও উন্নতি ঘটে। শুধু আইনের দ্বারা নিশ্চিত অধিকার নয়, শ্রমিকদের প্রতি অধিকতর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি শিল্পমালিকদের নৈতিক দায়ও বটে।

আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের প্রধান ক্রেতা বিদেশিরা। রপ্তানিমুখী এই শিল্পের শ্রমিকদের আন্দোলন করার দায়ে চাকরিচ্যুত করা, মামলার আসামি করে গ্রেপ্তার করা, চাকরিচ্যুতির হুমকি দেওয়া ইত্যাদি অভিযোগের খবর আন্তর্জাতিক মহলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। আমরা জোর দিয়ে বলি, মিথ্যা অভিযোগে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হোক, গ্রেপ্তার শ্রমিকদের মুক্তি দেওয়া হোক, চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হোক এবং চাকরিচ্যুতি বন্ধ করা হোক।