মন্ত্রী তো পেলাম, এবার উন্নয়ন

অনেক দিন পর রংপুর বিভাগ জেলায় জেলায় মন্ত্রী পেল। বিশেষ করে কুড়িগ্রাম কমসে কম ৩০ বছর পর মন্ত্রী পেল। আজব–জবর অর্থনীতির বাংলাদেশে যেসব জেলায় মন্ত্রী হয়, সাধারণত সেসব জেলায় কিছুটা উন্নতি হয়। জনগণ তাদের কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে বুঝেছে এই সম্পর্ক। তাই সম্ভবত কুড়িগ্রামবাসী এবার একটু বেশি খুশি। তারা দেখেছে, আসাদুজ্জামান নূর মন্ত্রী ছিলেন বলেই নীলফামারীতে আন্তনগর ট্রেন চলেছে, ইপিজেড আরও সম্প্রসারিত হয়েছে সৈয়দপুরে। বিএনপির আমলে আসাদুল হাবিব, বিগত দিনে জি এম কাদের ও মোতাহার হোসেন মন্ত্রী ছিলেন বলে লালমনিরহাটের লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেন বুড়িমারী পর্যন্ত চলেছে। কিছু লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু এসব উন্নতি দক্ষিণের জেলাগুলোর তুলনায় নগণ্য।

১৯০১ ও ১৯১১ সালের আদমশুমারির হিসাবমতে, অখণ্ড বাংলায় সর্বাধিক অভিবাসীর আগমন ঘটেছিল এই বৃহত্তর রংপুর জেলায়। 
স্বাস্থ্যকর ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যে মূল কারণ, তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। ভাবুন তো, কলকাতা নয়, নতুন প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা নয়; রংপুর ছিল অভিবাসীদের আকর্ষণীয় জেলা। সেই রংপুর জেলা, আজকের রংপুর বিভাগ হলো বাংলাদেশের দরিদ্রতম বিভাগ!

বাণিজ্যমন্ত্রী, রেলমন্ত্রী ও সমাজকল্যাণমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো উত্তরের জন্য বরাদ্দ করায় বোঝা যাচ্ছে, সরকার এবার উত্তরের জেলাগুলোর দিকে মনোযোগ দিয়েছে। সঙ্গে হয়তো এবার উত্তরের স্থলবন্দর ও নৌবন্দরগুলো সচল হবে—আশা করতে দোষ কী—রৌমারী পর্যন্ত রেল ও গ্যাসলাইন সম্প্রসারিত হবে। নতুন ইপিজেড প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট বিবেচিত হবে। আর সেগুলোর অনুষঙ্গ হিসেবে প্রতিটি জেলায় হাজার মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা-ধরলা-করতোয়ার পারে হতে পারে। চীনের যে বিপুল বিনিয়োগ করার কথা, তা উত্তরে অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের মধ্য দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখুক।

এ ক্ষেত্রে ব্রহ্মপুত্র নদের সম্ভাব্য ভূমিকার দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। ব্রহ্মপুত্রকে সজীব রাখার জন্য বৃষ্টির পানির পুনঃসঞ্চালন জরুরি। তার জন্য পানির ধারা অব্যাহত রাখার আয়োজন দরকার। ব্রহ্মপুত্রের উজানের পানি সরিয়ে নেওয়া যেমন ঠেকানো দরকার, তেমনি ব্রহ্মপুত্রের চরগুলোতে প্রাকৃতিক বন গড়ে তোলাও জরুরি। আকবর বাদশাহর আমলে ব্রহ্মপুত্রের উভয় তীরে এক ক্রোশ পর্যন্ত ভূমিতে হাল দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল, দুই পাড়ে যে বন ছিল, তা বৃষ্টির পানিকে আবার নদীতে ফিরে আসতে ভূমিকা রাখত। এখনো নিঝুম দ্বীপের আদলে ব্রহ্মপুত্রের চরগুলোতে তা করা সম্ভব, করা উচিত। উজানে ভারতীয় অংশে গন্ডারের অভয়ারণ্যে যেসব বৃক্ষ আছে, সেগুলো এখানে লাগালে বাকিটা আপনা–আপনি হয়ে উঠবে। পর্যটন এই অঞ্চলে নতুন অর্থনৈতিক খাত হয়ে উঠতে পারে। বিদ্যুৎ জোগানোর জন্য পরিবেশবান্ধব, সাশ্রয়ী ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে সৌরবিদ্যুতের অপার সম্ভাবনা আছে।

বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায় গড়ে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজের মতো উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান আছে কিন্তু কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ও পঞ্চগড় জেলায় একটিও নেই। ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, করতোয়ার পারে কেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে না? কয়েক বছর আগে তিস্তা নদীর ওপর চিলমারী-হরিপুর সেতুর নকশায় রেলপথ রাখার জন্য গণকমিটি আগের মেয়াদের রেলমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি আরও ৩০০ কোটি টাকা বাড়তি লাগবে বলে মন্তব্য করে বিষয়টা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। অথচ এটা হলে ভবিষ্যতে ফুলছড়ি-দেওয়ানগঞ্জ যমুনা সেতুর নিচে টানেলে যুক্ত করা সম্ভব হবে। এবার কি আশা করা মিছে হবে? চিলমারী থেকে ঢাকা রুটে ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেসের দাবি পূরণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুতি কি এবার পূরণ করা হবে?

রংপুরে বেকারত্বের হার বেশি। দেশে কর্মসংস্থানের অভাব, তাই এ অঞ্চলের শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তাঁরা বিদেশে গিয়ে কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠালে এই এলাকার উন্নতি ত্বরান্বিত হতে পারে। বিষয়টি সমাজকল্যাণমন্ত্রী নিশ্চয়ই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখবেন। যেখানে বাংলাদেশের জেলাপ্রতি প্রবাসী শ্রমিক আছেন গড়ে লাখখানেক, সেখানে লালমনিরহাটে তা মাত্র দুই হাজার।

২০ বছর ধরে বিএনপি-আওয়ামী লীগ মিলে প্রতি মেয়াদেই মন্ত্রী পেয়েছে লালমনিরহাট। কিন্তু শুধু লালমনি এক্সপ্রেস ও বুড়িমারী পর্যন্ত ট্রেন ছাড়া আর কিছুই জোটেনি।

রংপুর বিভাগের সঙ্গে ভারতের কয়েকটি রাজ্যের সীমান্ত। এখানে শিল্পকারখানা স্থাপন করা হলে উৎপাদিত পণ্য স্বল্প খরচে ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে রপ্তানি করা যাবে। এটা সম্ভব করে তুলবেন কি উত্তরের এতজন মন্ত্রী? প্রধানমন্ত্রী রংপুরের পুত্রবধূ, এই অঞ্চলের মানুষের আপনজন। তিনিও কি এবার এই অঞ্চলের দিকে সুনজর দেবেন?

নাহিদ হাসান, রেল-নৌযোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির সভাপতি