শপথের বৈধতা ও সংসদীয় রীতিনীতি

অপেক্ষায় ছিলাম সাংসদদের শপথের বৈধতা চ্যালেঞ্জের রিটে রায় পাব। কিন্তু হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ ‘উত্থাপিত হয়নি’ উল্লেখ করে ১৭ জানুয়ারি রিট খারিজ করেছেন। দশম সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি লিখেছিলাম, ‘সংবিধান রক্ষায় সংবিধান বিচ্যুত শপথ।’ এবারও চিত্রটি তা–ই। ভারতের উদাহরণ দেখিয়ে সংসদ না ভেঙে নির্বাচন করা হলো। অথচ তারা কখনো নির্বাচনের পরে লোকসভা না ভেঙে শপথ নেয়নি। বাংলাদেশে পরপর দুবার এটাই করা হলো।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, ৩০ জানুয়ারির আগে সংসদ শুরু হবে না বলে শপথ অবৈধ নয়। অথচ বাহাত্তরেই সংবিধান নির্দিষ্ট করেছে যে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করা হলে নির্বাচিতরা সংসদের মেয়াদ পূর্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ওই বিধানটি লুপ্ত ছিল, যা ২০১১ সালে ফিরিয়ে আনা হয়।

২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী প্রথম আলোয় ‘শপথ গ্রহণ নিয়ে সংশয়ের সুযোগ নেই’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। তাতে তিনি সংসদের মেয়াদ অবসানের আগেই শপথ নেওয়ার বিষয়ে সমালোচনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর নিবন্ধে দুটি মৌলিক বিষয় আলোচনা করেননি। একটি হলো উন্নত বিশ্বে নির্বাচনের আগে বা পরে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। সেটা আমরা কেন অনুসরণ করব না। দ্বিতীয়ত, সংসদ রেখে বা না রেখে নির্বাচন করা–সংক্রান্ত বাহাত্তরের স্কিমের মধ্যে খালেদা জিয়ার আনা একটি সংশোধনী (ফল গেজেটে ছাপা হওয়ার তিন দিনের মধ্যে শপথ গ্রহণ) রেখে দেওয়া। এ কারণে তাঁর যুক্তিতর্ক ছিল খণ্ডিত, অসম্পূর্ণ এবং অগ্রহণযোগ্য।

ড. রিজভী লিখেছিলেন, ‘সংবিধানের ১৪৮(২ক) অনুচ্ছেদের অধীনে নতুন নির্বাচিত সদস্যদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা সংসদের স্পিকারের জন্য বাধ্যতামূলক।’ এই অনুচ্ছেদটিকে আলাদা করে পড়লে তাঁর ব্যাখ্যা মানতে হয়। কিন্তু এর নেপথ্যের গল্পটা তো জানা চাই।

২০০৪ সালে বয়স বাড়িয়ে বিচারপতি কে এম হাসানকে বিএনপি প্রধান উপদেষ্টা পদে যোগ্য করেছিল। সেই সংশোধনীতে আরও কাণ্ড করা হয়েছিল। সংবিধানে নতুন ১৪৮(২ক) যুক্ত করে বলা হয়েছিল, ‘ফল গেজেটে ছাপা থেকে তিন দিনের মধ্যে নবনির্বাচিতরা শপথ নেবেন।’ এ সময় সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদ লুপ্ত এবং শুধু সংসদ ভেঙেই নির্বাচন করা যেত। সুতরাং একটি নতুন নির্বাচনের পরে নতুন নির্বাচিত সংসদ ও মন্ত্রিসভা গঠনই ছিল মূল আকর্ষণ। তাই ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ এই বিধান রেখে দিয়ে ভুলটি করেছে। এটি থাকতে পারে না অন্তত তিনটি কারণে। এই বিধানটি বিদ্যমান তিনটি অনুচ্ছেদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত তৈরি করে। প্রথমত, এটি সংসদীয় গণতন্ত্রের ঐতিহ্যের বিরোধী। বাহাত্তরের সংবিধানের মূল স্কিম পরিপন্থী। ১২৩ অনুচ্ছেদের ৩ দফার (ক) উপদফার শর্তাংশের সঙ্গে এর সংঘাত বাধে। এটি বলেছে, ‘মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্য হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করবেন না।’ দ্বিতীয়ত, ১৪৮(৩) অনুচ্ছেদ বলেছে, শপথ নেওয়া মাত্রই কার্যভার গ্রহণ করেছেন বলে গণ্য হবে। তৃতীয়ত, শপথ কখন কে, কাকে, কোথায় গ্রহণ করাবেন, সেটা স্পিকারের এখতিয়ার। ১৪৮(২) অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘যে রকম ব্যক্তি ও স্থান নির্ধারণ করবেন, সেই ব্যক্তির কাছে সেই স্থানে শপথ হবে।’ এটি তাই স্পিকারের এখতিয়ারকে সংকুচিত করে।

সুতরাং নতুন সংশোধনীর মাধ্যমে ওই শপথের আলটিমেটাম অপসারণ করা জরুরি।

কিন্তু বর্তমান অবস্থা বজায় থাকতে সংবিধানকে রক্ষা করার পথ ছিল শপথের তারিখ পেছানো। সে ক্ষেত্রে গেজেটে ফল প্রকাশের তারিখও পেছানো যেত। তা এমনভাবে করা উচিত ছিল, যাতে ২৮ জানুয়ারি শপথ নেওয়া যায়। আর তাতে বঙ্গবন্ধুর সংবিধান রক্ষা পেত। এখন অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য যে খালেদা জিয়ার বিতর্কিত চতুর্দশ সংশোধনীকে বাহাত্তরের সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া হলো। বোঝা যায় ক্ষমতা যাতে পাকাপোক্ত হয়, সেটা নিতেই হবে, সেখানে কোনো বাছবিচারের বিষয় নেই।

দশম সংসদ গেল কোথায়? মহাজোটের অনেক প্রবীণের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছি। কিন্তু কারও কাছে সদুত্তর পাইনি। অনেকেই মনগড়া, অস্পষ্ট বক্তব্য হাজির করলেন। সংসদ সচিবালয়ের নবনিযুক্ত জ্যেষ্ঠ সচিব ড. জাফর আহমেদ খান এবং আইন শাখার প্রধান যুগ্ম সচিব সুমিয়া খানমের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলি। ড. খানের কথায়, ‘যদিও ২৮ জানুয়ারি দশম সংসদ শেষ হবে, কিন্তু সেটা ফাংশনাল ছিল না। এখন শপথের পর ধরে নিতে হবে, নতুনটা টেকওভার করেছে।’ বললাম, এখন দুটি সংসদ আইনগতভাবে বিদ্যমান বলা যাবে কি? তিনি বলেন, ‘না। কোনোভাবেই না। সংবিধানেই প্রভিশন আছে, শপথ নিলে ধরে নিতে হবে নতুনটা অ্যাসিউম করেছে।’

এটা সংবিধানের কোথায় লেখা? ‘আমি এটা মুখস্থ বলতে পারছি না। আছে এটা।’ দশম সংসদ কি প্রজ্ঞাপন দিয়ে বাতিল করা হয়েছে?

 ‘না। বিলোপ করা হয়নি।’ এরপর সুমিয়া খানমের কাছে ‘টেকওভার’ বিষয়ে জানতে চাই। তিনি আমাদের ১২৩ অনুচ্ছেদের সঙ্গে ১৪৮ অনুচ্ছেদ মিলিয়ে দেখতে বলেন, যার আলোচনা আমরা ওপরে ইতিমধ্যে করেছি। ১৪৮ টিকেছে। ১২৩ টেকেনি।

সাংসদদের শপথের বিরুদ্ধে রিটকারীর দরখাস্তের যুক্তি হলো: সংবিধানের ১৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শপথের জন্য নির্বাচিতদের উচিত ছিল ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করা। আমরা এই যুক্তির জোরটা নাকচ করতে পারি না। সংবিধান ব্যাখ্যায় এমন পন্থা চাই, যাতে দুই কুল রক্ষা পায়।

ড. রিজভী তাঁর ২০১৪ সালের নিবন্ধে কেন মেয়াদ অবসানের আগে শপথ নিতে হয়, তার তিনটি বাস্তব কারণ চিহ্নিত করেন। তাঁর যুক্তি ছিল, ‘প্রথমত, শপথের পরই কেবল সংসদীয় নেতা মেলে। দ্বিতীয়ত, নেতা নির্বাচিত না হলে তিনি নতুন সংসদ ডাকতে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারেন না। তৃতীয়ত, সংসদের নেতা একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী-পদাধিকারী। তাঁকে তাঁর মন্ত্রী বাছাই এবং বিলম্ব ছাড়াই রাষ্ট্রের কার্যাবলি শুরু করতে হবে।’ অথচ প্রধানমন্ত্রীই সংসদ নেতা হবেন, সেটা সংসদীয় গণতন্ত্র বলে না।

১৬ মে ২০১৪ সবশেষ লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরদিন সকালেই মন্ত্রিসভা সংসদ ভাঙতে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ এবং বিকেলে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং পদত্যাগ করেন। রাষ্ট্রপতি তাঁকে নতুন মন্ত্রিসভা না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব চালিয়ে যেতে অনুরোধ করেন। ২০০৯ সালে সিং যখন দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হন, তখনো তিনি নির্বাচনের পাঁচ দিন পরে সংসদ ভেঙে দিতে পরামর্শ দেন। একই দিনে ইস্তফা দেন। এর চার দিন পর নতুন করে প্রধানমন্ত্রিত্বের শপথ নেন। বাংলাদেশে এই রীতির অনুসরণ কোথায়?

অলিখিত সংবিধানের দেশ হয়েও ব্রিটেন তাদের সরকারি ওয়েবসাইটে লিখেছে, সংসদ বিলোপের অর্থ হাউস অব কমন্সের প্রতিটি সদস্যের পদ শূন্য হওয়া। সাংসদদের প্রত্যেকের সাধারণ নাগরিকে পরিণত হওয়া। এমনকি সাংসদেরা শুধু সংসদে থাকা তাঁদের নথিপত্র সংগ্রহের জন্য মাত্র অল্প কয়েক দিনের জন্য সংসদে প্রবেশাধিকার পাবেন। সংসদ ভঙ্গ হওয়ার দিনে বিকেল পাঁচটা থেকে ওয়েস্টমিনস্টার থেকে তাঁরা যত ধরনের সুবিধা পেতেন, তা আপনা–আপনি বাতিল হয়ে যাবে।

স্পিকারের নিজেরও সাংসদ পদ থাকবে না। সংসদ ও সরকার দুটি আলাদা প্রতিষ্ঠান। সংসদ চলে গেলেও সরকার পদত্যাগ করে না। নতুন নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ পাওয়ার আগ পর্যন্ত সাবেক মন্ত্রিসভার সদস্যরা নিজ নিজ দায়িত্বে বহাল থাকেন। সংসদ বিলোপের পরে মন্ত্রীরা নিজেদের মন্ত্রী পরিচয় দিতে পারবেন। কিন্তু সাংসদেরা পারেন না। একটি নতুন নির্বাচনের পরে তাই সবার আগে শপথ নেন স্পিকার এবং তারও একটি ঐতিহ্য আছে। স্পিকারের পরে শপথ নেন ফাদার অব দ্য হাউস (জ্যেষ্ঠতম সাংসদ)। এরপর পূর্ণ মন্ত্রী, শ্যাডো মন্ত্রীরা মানে বিরোধীদলীয় সাংসদেরা। আমরা দেখলাম, মন্ত্রিসভার পরে মহাজোটের শরিকেরা শপথ নিলেন। ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলও গুরুত্ব পেল না।

সব দেশই কিছু স্বতন্ত্র ঐতিহ্য গড়েছে। প্রত্যেক সাংসদকে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী বাক্যে জ্যেষ্ঠতার ক্রম অনুযায়ী শপথ নিতে দেওয়ার নিয়ম চালু করা যায়। আমাদের রীতিনীতিগুলো বৈচিত্র্যহীন। এখানে পরিবর্তন আনা দরকার। ভারতে নতুন নির্বাচনের পরে নতুন স্পিকার নিয়োগের আগ পর্যন্ত শুধু শপথ পড়ানোর জন্য ‘স্পিকার প্রো–টেম’ বা অস্থায়ী স্পিকার নিয়োগ ও তাঁকে শপথ পড়ান রাষ্ট্রপতি। আমাদের স্পিকার নিজেই নিজের শপথ নেন। আমরা তাই এসবে পরিবর্তন আনার কথা বলি।

মিজানুর রহমান খান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]