দুর্নীতি বন্ধে চাই 'টোটাল কমিটমেন্ট'

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার, ‘দুর্নীতির প্রতি জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হবে।’ এবারই কোনো রাজনৈতিক দল এত সুনির্দিষ্ট ও কঠিনভাবে নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি দমনের প্রতিজ্ঞা করল। আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পিএইচডি করে ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর থেকে বলে চলেছি, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ৪৮ বছরে কোনো ‘দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতাসীন সরকার’ দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি, ২০০৭-০৮ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারই একমাত্র ব্যতিক্রম!

বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭৩ সাল থেকে তাঁর সরকারের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের অভিযোগ উঠেছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওই সব অভিযোগের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এ ব্যাপারে বেশ কয়েকবার প্রকাশ্যে উষ্মা প্রকাশও করেছিলেন বলে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমল থেকে ক্ষমতাসীন সরকার দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের অবস্থানে চলে যায়। রহস্যজনক হলো, জিয়া নিজেকে আর্থিক দুর্নীতি থেকে মুক্ত রাখলেও তাঁর আমলেই রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতিকে মেনে নেওয়ার প্রবণতা জোরদার হতে শুরু করে।

স্বৈরাচারী এরশাদের আমল থেকে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক—উভয় প্রকারের দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করে এবং গত ২৮ বছরের নির্বাচনী গণতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর সময়ে অর্থনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে থাকতেই বাংলাদেশ বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতি গবেষণা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ‘করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স’ র‍্যাঙ্কিংয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আরও চার বছর দুর্নীতির এই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ বাংলাদেশের কলঙ্কতিলক হিসেবে অক্ষুণ্ন ছিল। গত ১৪ বছরে ওই কলঙ্কতিলক আর না জুটলেও বাংলাদেশের অবস্থান এখনো একেবারেই নিচের দিকে (মানে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত) রয়ে গেছে। অতএব, আগামী পাঁচ বছর ক্ষমতাসীন থাকার মেয়াদে যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সত্যি সত্যিই সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন, তাহলে ইতিহাসে তিনি নিঃসন্দেহে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

এই অঙ্গীকার জনমনে প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছে যে দুদককে অকার্যকর করে রাখার কৌশল থেকে হয়তো প্রধানমন্ত্রী এবার সরে আসছেন। এই আশা যদি সত্য হয়, তাহলে মহান আল্লাহ তাআলার কাছে অশেষ শুকরিয়া। দেশের অর্থনীতিতে উন্নয়নের সুবাতাস বইছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশে পৌঁছে গেছে। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে পারলে আগামী দু–তিন বছরেই এই প্রবৃদ্ধির হার ৯ শতাংশ অতিক্রম করবে আশা করা যায়। নতুন সরকারের শুরুতেই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকদের এবং সরকারি প্রশাসনের সব৴স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির ব্যাপারে ‘টোটাল কমিটমেন্টের’ মেসেজটি যদি পৌঁছে দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) দুর্নীতিবাজদের শায়েস্তা করার জন্য উপযুক্ত ক্ষমতা প্রদানের আইনি পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়, তাহলে তাঁর এবারের অঙ্গীকার সম্পর্কে জনমনে বিশ্বাস জন্মাবে। নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নেওয়ার পর তিনি তাঁর প্রতিটি বক্তৃতায় এই অঙ্গীকারকে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছেন। এখন প্রয়োজন যথাযোগ্য ‘ফলোআপ অ্যাকশন’।

এ পর্যায়ে স্মরণ করছি, ২০০৭-০৮ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধূরীর নেতৃত্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন যে প্রবল গতিশীলতা অর্জন করেছিল, সে জন্য প্রথমবারের মতো দুর্নীতিবাজ ও পুঁজি লুটেরা রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছিল। দুদকের পাশাপাশি মেজর জেনারেল মতিনের নেতৃত্বাধীন দুর্নীতিবিরোধী শক্তিশালী জাতীয় কমিটিও রাজনীতিবিদ ও রাঘববোয়াল ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রবল ত্রাসের সঞ্চার করেছিল। ডিজিএফআই এটির তদন্ত পরিচালনা করার কারণে রাঘববোয়ালেরা ভয়ে তটস্থ থাকত। ওই দুই বছরে এ দুই ধরনের দুর্নীতিবাজদের যে প্রবল ‘ঝাঁকি দেওয়া’ সম্ভব হয়েছিল, সেটা দুদকের পরবর্তী চেয়ারম্যান গোলাম রহমান প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ওই সময়টায় দেশে প্রথমবারের মতো কোনো সরকারকে দুর্নীতি দমনে সত্যিকার নিষ্ঠাবান মনে হয়েছিল, আমার বেশ কয়েকটি লেখায় আমি নির্দ্বিধায় তা স্বীকার করেছি। (অবশ্য রহস্যজনকভাবে সামরিক কর্মকর্তা এবং উচ্চতর সিভিল আমলাদের দুর্নীতির অভিযোগগুলো ওই সময়ের দুদকের কিংবা মতিন কমিটির যথাযথ মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। বিশেষ করে, ২০০৮ সালে মাঠপর্যায়ের আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের একাংশ যেভাবে দুর্নীতির মচ্ছবে মেতে উঠেছিলেন, তার আলামত সারা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে এখনো! ওগুলোর জন্য কোনো দুর্নীতিবাজের শাস্তি হয়েছে কি?) দুঃখজনক হলো, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে পরিকল্পিতভাবে দুদককে অকার্যকর করার যাবতীয় প্রয়াস জোরদার করেছিল। প্রথমেই সরকার চরম অসহযোগিতার মাধ্যমে লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধূরীকে দুদকের চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করেছিল। ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক জারিকৃত দুর্নীতি দমন কমিশন অধ্যাদেশটি যথাসময়ে সংসদে অনুসমর্থনের জন্য উত্থাপন না করায় তা তামাদি হয়ে গেল। বহুদিন পর দুর্নীতি দমন কমিশনের জন্য যে বিলটি সংসদে উত্থাপন করে আইন হিসেবে পাস করা হলো, সেটা যে ওই পূর্বতন অধ্যাদেশের তুলনায় অতি দুর্বল একটি আইন—সেটা বুঝতে কারও বাকি রইল না। বোঝা গেল, মহাজোটের শাসনামলে দুদককে তদানীন্তন দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের ভাষায় ‘নখ–দন্তহীন ব্যাঘ্রে’র ভূমিকায় ফিরিয়ে নেওয়া হলো, তিনি অনেক দেনদরবার করেও সংসদের পাস করা ওই দুর্বল আইনটিকে পরিবর্তন করাতে পারেননি; বরং সরকারি প্রশাসনের উচ্চতর পদের আমলাদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত শুরুর আগে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হবে বলে বিধানও পাস করা হয়েছিল শাসকজোটের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত আমলাদের লবির কারণে।

বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আমার সাবেক শিক্ষক গোলাম রহমানের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হলে দুদকের ক্ষমতাহীনতা ও অকার্যকারিতা সম্পর্কে আমি অনুযোগ করেছি বেশ কয়েকবার। স্বল্পবাক্‌ এই ব্যক্তি নিজের ব্যর্থতায় বেদনাহত হলেও জনসমক্ষে কারও বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেননি, বেশির ভাগ সময় নীরবতা পালনই শ্রেয় মনে করেছেন তিনি। অবশ্য কয়েকটি বিরল মুহূর্তে দুদকের ব্যর্থতার জন্য যে সরকারের ‘ইচ্ছাশক্তির অভাব’কে প্রধানত দায়ী করে বিভিন্ন বক্তব্য তিনি মিডিয়ার সামনে প্রকাশ করেছেন, তাতে তাঁর সততার পরিচয় পাওয়া গেছে। তারপর দুদকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বদিউজ্জামান। তিনিও ব্যর্থ হয়েছেন দুদককে কার্যকর করতে। তাঁরও অভিযোগ: বিদ্যমান আইনের কারণে দুদক নখ–দন্তহীন ব্যাঘ্রই থেকে যাবে। বর্তমান চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ অত্যন্ত গতিশীল ও দক্ষ আমলা হিসেবে প্রশংসিত ছিলেন। (ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে কিছুদিন একটা কমিটিতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম আমি, তাই তাঁর নেতৃত্ব সম্পর্কে আমি আস্থাবান। একটা ভালো টিমও পেয়েছেন তিনি।) আমি মনে করি, বর্তমান আইনের পরিবর্তে ২০০৭-০৮ সালের দুদক অধ্যাদেশকে সংসদে বিল আনার মাধ্যমে নতুন দুদক আইনে পরিণত করা গেলে আবার এ সংস্থাটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হবে, শুধু দুদকের চেয়ারম্যান কিংবা কমিশনার পরিবর্তন যথেষ্ট হবে না। দুদকের জনবল নিয়োগের স্বাধীনতা এবং আর্থিক স্বাধীনতাও অপরিহার্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি ব্যাপারটা ভেবে দেখবেন?

সাম্প্রতিক নির্বাচনটা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও আগামী পাঁচ বছর শেখ হাসিনাই আবারও দেশকে নেতৃত্ব প্রদান করবেন, এটাই অনেকে আশা করেন। সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতি দমনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে দেশের অর্থনীতিতে অপ্রতিরোধ্য গতি সঞ্চার করাই তাঁর প্রথম অগ্রাধিকার হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। গণতন্ত্রের নামে দেশে যে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের সংস্কৃতি চালু করা হয়েছে, তা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য গ্লানিকর। গণতন্ত্রের সংগ্রাম এই জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের পথে ঠেলে দিয়েছিল, এটা আশা করি প্রধানমন্ত্রী ভুলে যাননি। আবার গণতন্ত্রের পথে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনের ব্যবস্থা বিঘ্নিত করার পরিণতিতেই ১৯৭৫ সালের আগস্টের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কুশীলবেরা জাতির পিতাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র হয়তো সফল করতে সমর্থ হয়েছিল—সেটাও অস্বীকার করা উচিত নয়। অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রদানের ব্যবস্থা গড়ে তুলতেই হবে আমাদের। ক্ষমতাসীন সরকারের অনেক সুকৃতি জনগণের কাছে সমাদৃত হবে, যদি সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকারের কঠোর অভিযান চালায়।

ড. মইনুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক

আরও পড়ুন: