'কাঁইয়ো কম্বল দিবার নয়?'

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

কুড়িগ্রাম কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক ও গণকমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক খন্দকার আরিফ ফোন দিয়ে বলছেন, ‘ভাই, ফেসবুকে মনে হয় দেখেছেন। আমরা কয়েকজন মিলে কিছু কিছু টাকা দিয়ে কয়েকটি কম্বল কিনছি। আপনিও যদি অংশ নেন, ভালো হয়।’ কুড়িগ্রামের বন্ধু লোকসংগীতশিল্পী নাজমুল হুদা দেখা পেয়ে বলছে, ‘যয়টাই হোউক কম্বল কিনি দে। চরোত দিয়া আসি। চরের অবস্থা ভালো নোমায়।’ এক বড় ভাই ফোন দিয়ে বলছেন, ‘এবার কাঁইয়ো কম্বল দিবার নয়?(এবার কি কেউ কম্বল দেবে না?)’ আমার কাছে যাঁরা কম্বলের খোঁজ করছেন, তাঁরা সবাই কুড়িগ্রামের হলেও বাস্তবে গোটা উত্তরাঞ্চলের একই চিত্র।

এখন শীতের মৌসুম। এ সময় শীত হবে—এটাই স্বাভাবিক। তবে সারা দেশে শীতের মাত্রা এক রকম নয়। বাংলাদেশে উত্তরাঞ্চল ছাড়া আর কোথাও শীতজনিত রোগের এত প্রাদুর্ভাব দেখা যায় না। হাসপাতালগুলোতে এসব রোগীর সংখ্যা বাড়ছেই। দেশের অনেক এলাকায় যখন ১২-১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মানুষ কাতর, তখন কুড়িগ্রামে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। শীতের কারণে মানুষ মারাও যাচ্ছে। শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আগুনের তাপ নিতে গিয়ে অসংখ্য মানুষ অগ্নিদগ্ধও হচ্ছে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসক অজয় রায় জানান, সেখানে ঠান্ডা থেকে রক্ষা পেতে অগ্নিদগ্ধ হওয়া অনেক রোগী ভর্তি আছেন। এ রকম অগ্নিদগ্ধ চারজন রোগী মারাও গেছেন। দু-তিন দিন আগে রংপুর রেলস্টেশনে কথা হচ্ছিল সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার সরকারের সঙ্গে। তিনি ট্রলিতে করে রেললাইন চেক করেন। প্রদীপ কুমার বলছিলেন, ‘শীতের সময় খোলা ট্রলিতে আমাকে লাইন চেক করতে হয়। ভীষণ কষ্ট। মনে হয় কুয়াশা এসে বাড়ি দেয় মুখে।’

শ্রেণিবিশেষে শীত থেকে কেউ রক্ষা পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না। যাঁরা গৃহস্থালি কাজে নিয়োজিত, তাঁদের পানির কাজ করতেই হয়। বিকল্প কোনো উপায় নেই। গৃহস্থালি কাজে নারীদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট সহ্য করতে হয়। ঠান্ডা যত তীব্র হোক না কেন, নিয়মিত খাবারের ব্যবস্থা তো বন্ধ থাকে না। যাঁরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাঁদেরও ঠান্ডা থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন। কয়েক দিন আগে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার তিস্তাসংলগ্ন পশ্চিম পাঁজরভাঙ্গা গ্রামে গিয়েছিলাম। আমরা যাঁরা গিয়েছিলাম, তাঁদের প্রত্যেকে জুতা পরা, অনেকগুলো গরম কাপড়ে মোড়ানো শরীর। তীব্র শীতে টিকে থাকতে না পেরে, কেউ কেউ ফেরার জন্য তাগাদা দিচ্ছিলেন। আবদুল হালিম ছোট নৌকায় উঠে জাল দিয়ে মাছ ধরছিলেন। চালায় কীভাবে মাছ ধরছেন, এ কথা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, ‘প্যাটে খাইলে শরীলে সয়। হামার ঠান্ডার কথা ভাবলে হইবে? তা হইলে খামো কী?’ সত্যি তো, ঠান্ডার কথা ভাবলে তাঁর পরিবার কী খেয়ে থাকবে?

আমার বাসার পাশেই খোকসা ঘাঘট নদসংলগ্ন মাঠ। সেখানে লক্ষ করলাম তীব্র শীতের সকালে একজন পুরুষ আর তিনজন নারী একটি বীজতলা থেকে ধানের বীজ তুলছেন। তারপর সেগুলো কাদাপানিতে নেমে রোপণ করলেন। আলুর খেতেও কাজ করছেন অনেকেই। উত্তরাঞ্চলে বোরো মৌসুমে যে কোটি কোটি হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়, সেগুলো বীজতলা থেকে তুলে এনে তীব্র শীতে কাদাপানিতে নেমেই রোপণ করা হয়। আমাদের ধোঁয়া ওড়া ভাতের নেপথ্যে শীতার্ত কৃষকের করুণ গল্প আছে।

গ্রামের কোটি কোটি মানুষ এখনো পুকুরের পানিতেই গোসল করে। যে পানিতে হাত রাখলে মনে হয় হাত জমে যাবে, সেই পানিতে তাদের গোসল করতে হয়। উত্তরাঞ্চলে যে মাত্রায় শীত পড়ে, এতে গবাদিপশুরও সমস্যা দেখা দেয়। গবাদিপশুগুলোও শীতে কাঁপতে থাকে। অল্পসংখ্যক মানুষ গরু-ছাগল-মহিষের গায়ে গরম কাপড় দেন, পানি গরম করে খাওয়ান। বাকিগুলোর কষ্টেই কাটে।

আমাদের উন্নয়নের গল্পে যে স্বস্তির ঢেকুর তুলি, তার প্রধান কারিগর আমাদের কষ্ট করা মানুষগুলোই। শীত মৌসুম এলেই তাঁরা অন্যের দ্বারস্থ হন একখানা গরম কাপড়ের জন্য। প্রতিবছরই এসব মানুষের পাশে কিছু সংগঠন, কিছু ব্যক্তি দয়াপরবশ হয়ে কিছু কিছু গরম কাপড় দেওয়ার চেষ্টা করেন। প্রয়োজনের তুলনায় তা অত্যন্ত কম। সরকারিভাবে এই উদ্যোগ চোখে পড়ে না। সরকার সামাজিক নিরাপত্তাবলয় শক্ত করার জন্য নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সেই কর্মসূচির অংশ হিসেবে দারিদ্র্যপীড়িতদের মধ্যে পর্যাপ্ত গরম কাপড়ের ব্যবস্থা করারও প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বেসরকারিভাবে যেগুলো দেওয়া হয়, সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকে না। ফলে যেটুকু সহযোগিতা থাকে, তা–ও যথাস্থানে হয়ে ওঠে না।

লালমনিরহাট-কুড়িগ্রামের বিভিন্ন গ্রামে গরম কাপড় ফেরি করে বিক্রি করেন ওমর আলী। রংপুরে এসেছিলেন পাইকারি দামে গরম কাপড় কিনতে। তিনি বলছিলেন, ‘গ্রামোত এলাও গরিব মাইনসের গরম কাপড়ের খুব অভাব। ডিম বেচে, লাউ বেচে, মাইনসের বাড়িত কাম করি টাকা জমে অনেকে কাপড় কেনে।’

শীতকাল উত্তরাঞ্চলের জনজীবনে ভিন্ন এক আবহ নিয়ে আসে। রংপুর শহরে রাত ১১–১২টা পর্যন্ত কেনাবেচা চলে। কিন্তু শীতের দিনগুলোতে রাত ৯টার আগেই শহর খালি হয়ে যায়। রোগীরা বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করেন। বৃদ্ধরাও সাবধানে থাকেন। শিশুদের নিয়ে মায়েদের সতর্কতার অন্ত নেই। ৬–৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে উপেক্ষা করেও চলতে থাকে দৈনন্দিন জীবনের কাজ। প্রকৃতির প্রতিকূলতাকে জয় করেই এগিয়ে যায় উত্তরের মানুষ।

বিত্তশালীদের অনেকেই মোটা মোটা কাপড় পরেন, মোটা লেপ–কম্বল মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকেন। কেউ কেউ রুম হিটারও ব্যবহার করেন। দরজার নিচ দিয়ে ঠান্ডা প্রবেশ করার পথও অনেকেই বন্ধ করে দেন। তারপরও অনেকেই ঠান্ডায় কাঁপতে থাকেন। ঠিক এমন শীতেই অনেকেই টিনের চালার ঘরের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। টিনের ঘরে শীতের অবাধ প্রবেশ। ঘরের বাইরের ও ভেতরের তাপমাত্রা সমান থাকে। আবার তাদের শীতের পোশাকও কম। এই মানুষগুলোর কথা যদি সমাজের উচ্চবিত্তরা ভাবেন, তাদের শীত নিবারণে এগিয়ে আসেন, তাহলে সারা দেশের মানুষ শীতের কষ্ট থেকে অনেকটাই রক্ষা পেতে পারে। তবে এ দায়িত্ব সবার আগে এবং প্রধানত সরকারের।

তুহিন ওয়াদুদ, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপল–এর পরিচালক
[email protected]