ভূমিধস জয় ও তার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব

সব নির্বাচনেই চমক থাকে। তবে বাংলাদেশের এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল পুনরায় ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থকদেরও দারুণভাবে চমকে দিয়েছে। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটই যে ক্ষমতা পাচ্ছে, তা নিয়ে খুব একটা সন্দেহ ছিল না। কিন্তু চূড়ান্ত ফল সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে। এখন নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে গজিয়ে ওঠা প্রশ্নবোধক চিহ্নটা ক্রমেই বড় হচ্ছে। এই নির্বাচন ঘিরে শুধু রাজনৈতিক দলের সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তা নয়, বরং কার্যকর গণতন্ত্র এবং এই নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন রয়ে গেছে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৬টি দলের জোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন পেয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ একাই পেয়েছে ২৫৭টি। তার শরিক দল জাতীয় পার্টি পেয়েছে ২০টি আসন। ২০১৪ সালের ফাঁকা মাঠেও আওয়ামী লীগ এতসংখ্যক আসন পায়নি। তখন তারা পেয়েছিল ২৩৪টি আসন। গোপালগঞ্জের নিজ আসনে শেখ হাসিনা পেয়েছেন ২,২৯, ৫৩৯ ভোট। সেখানে বিএনপির প্রার্থী এ এম জিলানি পেয়েছেন ১২৩ ভোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মোহাম্মাদ মারুফ শেখ পেয়েছেন ৭১ ভোট এবং অন্যরা পেয়েছেন ১৪ ভোট। এই নির্বাচনে বিরোধী জোট সব মিলিয়ে পেয়েছে মাত্র ৮টি আসন।

নির্বাচনের আগের ঘটনাপ্রবাহ দেখে বোঝা যাচ্ছিল বিরোধী দলগুলো চূড়ান্ত রকমের দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং নির্বাচন থেকে দূরে সরে যাওয়া কিংবা নির্বাচনের বিকল্প কোনো পন্থা ঘোষণা করার সামর্থ্যও দৃশ্যত তাদের ছিল না। নির্বাচনের পর বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিনন্দন জানানোর যথেষ্ট কারণও আছে।

বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল দেশ হলো বাংলাদেশ। এমনকি প্রবৃদ্ধি অর্জনে চীনকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরে দেশটির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ২৮। অর্থমূল্যের হিসাবে এই বছরে মোট জাতীয় উৎপাদন ছিল ২৫ হাজার কোটি ডলার। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর মাথাপিছু আয় তিন গুণ হয়েছে। গত এক দশকে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে মানব উন্নয়নে ভালো করে এসেছে। একই সঙ্গে বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যসীমা থেকে তুলে আনার জন্য বিশ্বব্যাংক দেশটির ভূয়সী প্রশংসা করেছে।

বাংলাদেশের পোশাকশিল্প থেকে রপ্তানি আয় এসেছে ৩ হাজার কোটি ডলারের বেশি। এই খাতে চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। গত ১০ বছরে জ্বালানি খাত থেকে অবকাঠামো খাতেও দ্রুত অগ্রগতি দেখা গেছে। একসময় যে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করা হতো, সেই দেশ লক্ষণীয়ভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে এসেছে। এর চেয়ে বড় কথা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে শেখ হাসিনা এক অনন্য মানবতার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন।

২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পুরো সময়টা বাংলাদেশ উন্নয়ন আর অগ্রগতির যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু এত কিছুর পরও শেখ হাসিনার সরকার নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়ে গেছে। বাংলাদেশ রাজনৈতিক কূটকৌশলের সঙ্গে অপরিচিত—বিষয়টি মোটেও তা নয়। দেশটি বারবার কর্তৃত্ববাদী শাসন, অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান, অনিয়ম ও অপশাসনের শিকার হয়েছে। প্রায় ১৫ বছর পর বাংলাদেশ ১৯৯১ সালে আবার গণতন্ত্র ফেরত পেলেও ২০০৬ সালে আবার দেশটি রাজনৈতিক সংকটে পড়ে যায়। আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার অবস্থানকে দেশের রাজনৈতিক প্রধান বিভক্তির প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা জয়লাভ করার পর ফল বিশ্লেষণ করে মোটা দাগে বোঝা যায়, দেশের ভোট তিন ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ হাসিনাকে সমর্থন করে। এক ভাগ খালেদাকে এবং আর এক ভাগ দোদুল্যমান ভোটার।

বাংলাদেশে বর্তমানে যে সংকট চলছে তার মূলে আছে ২০১১ সালের জুনে পাস করা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী। ওই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি পুরোপুরি বাতিল করা হয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল, ‘রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তায়’ পরবর্তী দুই মেয়াদে (অর্থাৎ দশম ও একাদশ সংসদ) তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকতে পারবে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতিতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে। এর ফলে আওয়ামী লীগ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩টি আসনসহ মোট ২৩০টি আসন পায়। ২০০৮ সালে ৮৭ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে গেলেও এবারের নির্বাচনে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ ভোটার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে থাকতে পারেন।

এবার সরকার কোনো ঝুঁকির মধ্যে যেতে চায়নি। বিএনপিকে একেবারেই দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। খালেদাকে ২২টি মামলায় আসামি করে জেলে পুরে রেখেছে। তাঁর ছেলে তারেক রহমানকে একই ধরনের মামলা দিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি এখন লন্ডনে অবস্থান করছেন। এর সঙ্গে নেতৃত্বশূন্যতা ও দূরদৃষ্টির অভাব বিএনপিকে একেবারেই কোণঠাসা করে ফেলেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ভূমিকার কারণে জামায়াতে ইসলামীর বিষয়ে অধিকাংশ মানুষের বিতৃষ্ণা আছে। তা সত্ত্বেও বিএনপি দলটির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছে। এটি নতুন প্রজন্মের ভোটারদের কাছে খুবই অপছন্দের ছিল।

ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত জনগণের খুব একটা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ক্ষমতাসীন সরকারের ভুলভ্রান্তি শুধরে দেশকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার প্রতিশ্রুতি ছিল। সেটি ভোটারদের কিছুটা আগ্রহীও করেছিল। কিন্তু সমগ্র জাতির মনোজগৎকে তা নাড়া দিতে পারেনি। সরকারবিরোধী দলগুলো গত সপ্তাহেও সরকারের সঙ্গে সংলাপের ওপর আলোকপাত করেছে এবং ঐক্যবদ্ধ বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে এখনো তারা ব্যর্থ হচ্ছে।

বাংলাদেশের একের পর এক ঘটনাক্রম শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের রূপ দেখাচ্ছে। বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় তিনি কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন, ইসলামি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালিয়েছেন। আবার আওয়ামী লীগই কট্টর ইসলামি সংগঠন হেফাজতে ইসলামের প্রতি সমর্থন দিয়েছে। নির্বাচনের আগে থেকেই মিডিয়ার ওপর শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ছিল।

অন্যদিকে ভারত আওয়ামী লীগের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে আসছিল। বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিগত যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যাচ্ছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে ভারতের আঞ্চলিক অভিযাত্রায় বাংলাদেশ তার খুবই গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী। এ কারণে বাংলাদেশের নির্বাচনে দেশটির একধরনের প্রভাব কাজ করে থাকে। মজার ব্যাপার হলো, এবারের নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে ভারতবিরোধী প্রচার–প্রচারণা খুব একটা দেখা যায়নি। ভারতের সমর্থন পেতে বিরোধী দলগুলো বোঝানোর চেষ্টা করেছে, ভারতের বিষয়ে তারা তাদের অবস্থান বদলেছে।

স্বল্প মেয়াদের কথা ভাবলে বলা যায়, বাংলাদেশের এই নির্বাচনী ফল ভারতের স্বার্থ পূরণে সহায়তা করবে। তবে দীর্ঘ মেয়াদের কথা চিন্তা করলে মনে হবে, এই একপক্ষীয় নির্বাচন ভবিষ্যতে দুর্দশা বয়ে আনতে পারে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করে না; তা নির্ভর করে রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের, জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের ওপর। ভারতকে এই বৃহৎ ক্যানভাসের কথা ভুলে গেলে চলবে না।

অর্গানাইজার ডট ওআরজি থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

ড. শ্রীরাধা দত্ত: ভারতের কলকাতার বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো