রাজনীতিতে 'আচ্ছন্ন' দেশের এ কী হাল!

মার্শা বার্নিকাট বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে সম্প্রতি বিদায় নিয়েছেন। মনে আছে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মতো এমন রাজনীতিতে আচ্ছন্ন দেশ আমি আর দেখিনি’ (লাইভ মিন্ট, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬)। এর ঠিক দুই বছর পর বাংলাদেশে গত ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেল। বাংলাদেশ বা এর জনগণ রাজনীতিতে ‘আচ্ছন্ন’—এর কোনো প্রমাণ এবারের এই নির্বাচন ঘিরে আদৌ মিলল কি? এ কী হাল বাংলাদেশের! দেশটির জনগণ কি তবে দুই বছরের মধ্যেই এতটা বদলে গেল! নাকি মার্শা বার্নিকাটের ধারণাটাই ভুল?

মার্শা বার্নিকাটের এই মন্তব্যের বছর তিনেক আগে (২০১৩) একটি জরিপ করেছিল মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার। বিশ্বের ৩৩টি উন্নয়নশীল ও উদীয়মান দেশের ওপর সেই জরিপ চালানো হয়েছিল। সেই জরিপে রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় জনগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশিদের নাম এসেছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপের তথ্য অনুয়ায়ী বাংলাদেশের ৬৫ ভাগ মানুষ উচ্চমাত্রায় এবং ২৯ ভাগ মানুষ মধ্যমমাত্রায় রাজনীতিতে সক্রিয়। এই দুটিকে যোগ করলে বলতে হয়, বাংলাদেশের ৯০ ভাগের বেশি মানুষ কোনো না কোনো মাত্রায় রাজনীতিতে সক্রিয়।

বাংলাদেশে নির্বাচনের আরেক নাম অনেকের কাছেই ‘ভোট উৎসব’। কারণ, নির্বাচন একটি উৎসবের আমেজ নিয়ে হাজির হয়। একটা দীর্ঘ সময় ধরে সেই উৎসব চলে। এবার শুধু মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া, বাছাই ও দাখিল নিয়ে উৎসবের আমেজের কিছুটা টের পাওয়া গেছে। রাজনীতির মাঠ কয়েক বছর ধরেই সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটের দখলে। নির্বাচনী উৎসবে এর ব্যতিক্রম ঘটবে, এমন আশা কেউ করেনি। তবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর রাজনীতির মাঠে কোণঠাসা বিএনপি কিছুটা চাঙা হয়ে ওঠে মূলত মনোনয়ন নিয়ে। সরকারের দমন-পীড়নে গত প্রায় চার বছর যে দলটি মাঠেই নামতে পারেনি, মনোনয়ন নিয়ে সেই দলে খেয়োখেয়ি কম হয়নি। দেশে থেকে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যাঁরা, তার বাইরে মনোনয়ন নিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে লন্ডনের স্কাইপ কল। মনোনয়ন নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে দলের নেতাদের মধ্য থেকেই। আওয়ামী লীগের নেতারা তো কথায় কথায় এ নিয়ে বিএনপিকে খোঁটা দিয়ে যাচ্ছেন।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো, দল ও জোটের মনোনয়ন বাছাই করাই যেন ছিল বিএনপির একমাত্র নির্বাচনী কাজ। ব্যস, এরপর আবার ঘরে ঢুকে গেছে দলটি। শোনা যাচ্ছিল, নির্বাচন কমিশনে মনোনয়ন চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই শেষ হলেই বিএনপি মাঠে নামবে। এরপর শোনা গেছে, ১৬ ডিসেম্বরের পর সেনাবাহিনী নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে দলটি। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী নামল নির্বাচনের মাত্র পাঁচ দিন আগে। ২৫ ডিসেম্বরের পরও বিএনপিকে মাঠে দেখা গেল না। এরপর শুনলাম, ভোটের দিন নাকি ভোটবিপ্লব হবে। ভোটারদের ভোটের দিন মাঠে থাকতে, ভোটকেন্দ্র পাহারা দিতে এবং ফলাফল নিয়ে বাড়ি ফেরার আহ্বান জানানো হলো। ভোটের দিনও মাঠে বিএনপি বা বিরোধী পক্ষের কারও দেখা মিলল না।

বিএনপি বা বিরোধীরা কেন মাঠে নামতে পারেনি, তার জবাব তাদের কাছে আছে। সরকার, পুলিশ ও প্রশাসন তাদের মাঠে নামতে দেয়নি। এর যে সত্যতা আছে, তা জনগণ জানে। বিরোধীদের ওপর হামলা, মামলা, গ্রেপ্তার ও ভয়ভীতি দেখানো—এর সবই হয়েছে। গায়েবি মামলার কথাও আমরা জানি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে বিএনপির মাত্রাছাড়া সহিংসতার জের ধরে বিরোধীদের ওপর সরকার যে দমন-পীড়ন শুরু করে, তা গত পাঁচ বছর ধরেই চলছে। তবে কথা হচ্ছে, সরকার দমন-পীড়ন চালালে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি মাঠ ছেড়ে দেবে—আমাদের রাজনীতির ইতিহাস তেমন সাক্ষ্য দেয় না। বিএনপি কি তবে আশা করেছিল নির্বাচনের আগে সরকার আমূল বদলে যাবে? যদি তা মনে না করে থাকে, তাহলে নির্বাচনের মাঠে তারা কী কৌশল নিয়ে নামতে চেয়েছিল? কিসের ওপর ভিত্তি করে তারা ভোটবিপ্লব করতে চেয়েছিল? কর্মী-সমর্থকদের তারা মাঠে নামাতে ব্যর্থ হলো কেন? বিএনপি কি একটি অথর্ব দলে পরিণত হয়েছে? অথবা জনগণ কি বিএনপির পক্ষে মাঠে নামতে চায়নি? নাকি রাজনীতিতে ‘অতিমাত্রায় সক্রিয়’ বাংলাদেশের জনগণ রাজনীতি, নির্বাচন—এসবে আগ্রহ হারিয়েছে? এই প্রশ্নগুলো এখনো বড় ধাঁধা হয়ে ঝুলে আছে।

২০১৩ সালের পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপের তথ্য-উপাত্ত বলছে, বাংলাদেশের ৪৮ শতাংশ মানুষ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেয়। ৩৭ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন ধরনের বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নেয়। সেই পরিস্থিতি কি গত পাঁচ বছরে এতটাই বদলে গেল যে সরকার, প্রশাসন ও পুলিশের বাধা ও দমন-পীড়নের কারণে বিএনপির মতো রাজনৈতিক দল মাঠেই থাকতে পারছে না! নির্বাচনের প্রচারণায় তো নয়ই, এমনকি ভোটের দিনও বিরোধী দল বা তাদের কর্মী-সমর্থকদের খুঁজে পাওয়া যাবে না! নির্বাচন যে দেশের মানুষের কাছে উৎসব হিসেবে বিবেচিত, তারা উৎসব থেকে নিজেদের এভাবে গুটিয়ে নিল? নির্বাচনের সময়ে গ্রামগঞ্জের চায়ের দোকানগুলো গভীর রাত পর্যন্ত সরগরম থাকবে না, আড্ডা জমবে না, তর্ক-বিতর্ক হবে না—এটা কী করে হয়!

পাঁচ বছর আগের জরিপের তথ্য-উপাত্ত না হয় অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। পরিস্থিতিও অনেক বদলে গেছে। কিন্তু পাঁচ মাস আগের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে আমরা অস্বীকার করি কীভাবে! একটি সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্কুলের শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন শুরু করেছিল, তা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। এটা দৃশ্যত কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না। কিন্তু এই আন্দোলনের প্রতি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও আন্দোলনের সমর্থনে জনগণের নেমে আসা এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক সক্রিয়তারই প্রমাণ দেয়। ছোটদের শুরু করা এই আন্দোলন কার্যত একটি নাগরিক অধিকারের আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল, যার সঙ্গে সুশাসন ও জবাবদিহির সম্পর্ক রয়েছে। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বা ‘রাষ্ট্র মেরামতের’ দাবি ওঠে যে আন্দোলন থেকে, তাকে শেষ পর্যন্ত বড় রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। দেশের তখনকার অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি, একধরনের নির্বিকার মনোভাব, বাক্স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়া ও ভয়ের সংস্কৃতি—এসব মিলিয়ে হতাশ হয়ে পড়া অনেকেই এই আন্দোলনের মধ্যে আশার আলো দেখেছিলেন। তখন অনেকে ভেবেছেন, সমাজে এখনো অন্যায় ও অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ও এ নিয়ে কথাবার্তা বলার পরিস্থিতি শেষ হয়ে যায়নি। সরকার শেষ পর্যন্ত সেই আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করেছে এবং আমরা দেখলাম, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চেয়ে ‘হেলমেট বাহিনী’ সেই আন্দোলন দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখে।

৩০ ডিসেম্বরে নির্বাচন ও এর আগে-পরের পরিস্থিতি আমাদের আবার নতুন করে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এ সময়ে আমরা যা দেখলাম, তাতে রাজনীতিতে ‘আচ্ছন্ন’ দেশ বা রাজনীতিতে অতিমাত্রায় ‘সক্রিয়’ জনগণের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না। এটা কি স্বাভাবিক রূপান্তর, নাকি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি? বিএনপি দাবি করে আসছে, সরকারের দমন-পীড়ন, ভয়ভীতি, গুম, মামলা, গায়েবি মামলা এবং সরকারের পক্ষে প্রশাসন ও পুলিশ কাজ করায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে বলতে হয়, সরকার এই কাজে শতভাগ সফল হয়েছে। এর শুরুর ধাক্কা বিএনপির ওপর দিয়ে গেছে। দল হিসেবে বিএনপিকে কার্যত অকার্যকর করে ফেলা সম্ভব হয়েছে। এটাকে আওয়ামী লীগে তার রাজনৈতিক সাফল্য হিসেবে উদ্যাপন করতে পারে। কিন্তু এমন কৌশলের বিপদ হচ্ছে, চূড়ান্ত বিচারে তা আসলে বিরাজনৈতিকীকরণকেই উৎসাহিত করে। দেশের রাজনৈতিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

নির্বাচনের ফলাফল যা হয়েছে, তা একচেটিয়া। এই ফলাফল নিয়ে বিস্ময় আছে। কারচুপি ও অনিয়মের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। তবে নির্বাচনে যে বিরোধী পক্ষকে মাঠে পাওয়া গেল না, এটাই সম্ভবত এই নির্বাচনের সবচেয়ে বড় সংকট। বাংলাদেশের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু নির্বাচনে অংশ নেওয়া একটি দল মাঠে নেই, এমন ঘটনা বাংলাদেশে আগে ঘটেনি। বিএনপিকে মাঠে নামতে দেওয়া হয়নি, এর সত্যতা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু বিএনপি যে বাধা ডিঙিয়ে মাঠে নামতে পারল না, একটি রাজনৈতিক দলের জন্য এরচেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে! আর জনগণ যে ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে বিএনপির পক্ষে মাঠে নামতে আগ্রহী নয়, তার ইঙ্গিতও পরিষ্কার। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা যদি বিরোধী দলকে মোকাবিলা না করে নির্বাচনে জিততে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন, তবে সেই দল রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হতে বাধ্য। বিরোধী দল বলে কিছু থাকবে না, আবার একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ক্ষমতাসীন দলও শক্তি হারাবে—এমন পরিস্থিতি আর যা–ই হোক, কোনোভাবেই রাজনীতি-সহায়ক নয়।

রাজনীতি নিয়ে ‘আচ্ছন্ন’ বাংলাদেশের মানুষ যদি স্বাভাবিক রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয় অথবা বিচ্ছিন্ন থাকতে বাধ্য হয়, তবে সেই অবস্থা অস্বাভাবিক। সব ধরনের বিচ্ছিন্নতাই বিপজ্জনক, রাজনৈতিক বা সামাজিক। রাজনৈতিক সক্রিয়তা এবং মতপ্রকাশ ও গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা আছে যে দেশের জনগণের, সেখানে রাজনীতি-বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতি বেশি বিপজ্জনক। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ‘অশুভ শক্তি’ বলতে যাদের বোঝানো হয়, তাদের বিকাশের জন্য এমন পরিবেশ বেশ অনুকূল।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক
akmzakaria@gmail. com