বাংলাদেশ নিয়ে চীনের ভাবনা ও দুর্ভাবনা

বাংলাদেশের নির্বাচন–পরবর্তী বিষয় নিয়ে চীনের ভূমিকা কী এবং তাদের চিন্তাভাবনা কেমন, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে একধরনের কৌতূহল আছে। বেশির ভাগ ইস্যুতে চীনের নীতিনির্ধারকেরা যেহেতু বরাবরই খুব সতর্কভাবে তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, সেহেতু তাঁদের ভাবনাচিন্তা আন্দাজ করা সহজ নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারক, কূটনীতিক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী নেতা, বিশ্লেষক ও সাংবাদিকেরা চীনের গতিবিধি বোঝার জন্য গ্লোবাল টাইমস পত্রিকার বিভিন্ন প্রতিবেদন ও লেখালেখির ওপর নির্ভর করেন। এই পত্রিকাটি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র পিপলস ডেইলি–এর অধীনে ছাপা হয়। মূলত আন্তর্জাতিক বিষয়াদি নিয়ে চীন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি গ্লোবাল টাইমস–এ তুলে ধরা হয়। এই পত্রিকাটির ভাষ্যের মধ্য দিয়ে বেইজিংয়ের নেতাদের আনুষ্ঠানিক নীতির গতি–প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করেন তাঁরা।

সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘কোয়ার্টজ’কে ২০১৬ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গ্লোবাল টাইমস–এর প্রধান সম্পাদক হু জিন বলেছিলেন, তাঁদের পত্রিকায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা কী ভাবছেন, তার একটা প্রতিফলন প্রায় সব সময়ই থাকে, যদিও এ বিষয়টির সরাসরি স্বীকারোক্তিমূলক ঘোষণা তাঁরা দেন না।

বাংলাদেশের নির্বাচনের মাত্র চার দিন পরই ৩ জানুয়ারি গ্লোবাল টাইমস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল, ‘বিভক্তির রাজনীতি পরিহার করতে পারলে বাংলাদেশের সম্ভাবনা আরও বিস্তৃত হবে’। এই প্রতিবেদনটি এবং কয়েক মাস ধরে একই পত্রিকায় ছাপা হওয়া দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক অন্যান্য আরও কিছু কলাম ও মন্তব্য প্রতিবেদন পড়লে বাংলাদেশ সম্পর্কে চীনের নেতাদের ভাবনাসংশ্লিষ্ট কিছু ধারণা পাওয়া যাবে।

গ্লোবাল টাইমস–এ উল্লেখিত নিবন্ধে আমাদের নির্বাচন নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং নির্বাচন–পরবর্তী সময়ে কী কী করা দরকার, সে বিষয়েও কিছু বলা হয়েছে। সেখানে প্রধানত যা আছে:

১. প্রতিবেদনে নির্বাচনের ফলকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন জোটের ‘ভূমিধস জয়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

২. প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে: বিরোধীরা নির্বাচনের ফলকে প্রত্যাখ্যান করে পুনর্নির্বাচন দাবি করেছে।

৩. নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে এবং নির্বাচনীয় অনিয়মের কথা উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) যে বিবৃতি দিয়েছে, তা ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

৪. প্রতিবেদনটিতে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়েছে, নির্বাচনের পর বিভক্তি বেড়ে যেতে পারে এবং তার সুযোগে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ বাড়তে পারে; এ বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে।

৫. ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের দলগুলোর এই সহিংসতাকে ‘বহুদলীয় পদ্ধতির নেতিবাচক প্রভাব’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

৬. প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সময়টাতে রাজনৈতিক মেরুকরণ কমিয়ে আনা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা থাকা খুবই জরুরি।

৭. প্রতিবেদনে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে রাজনৈতিক বিভাজন কমিয়ে আনা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মৌলিক ইস্যুতে এক থাকার প্রবণতা বাড়ানো দরকার।

৮. সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সব দলের প্রতি হানাহানি বন্ধ করে দেশ গড়ায় ঐক্যবদ্ধ হতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

৯. প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দলগুলোকে শুধু জনসমর্থন পাওয়ার সংগ্রাম না চালিয়ে ‘জনগণের বৃহত্তর কল্যাণে’ সংগ্রাম চালাতে বলা হয়েছে।

নির্বাচনের ফলের প্রতি চীনের যে অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে, তা ভোটের পরপরই পরিষ্কার হয়ে গেছে। ভোটের পরপরই নতুন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এবং প্রধানমন্ত্রী লি কেছিয়াং স্বাগত জানান। তাঁদের তড়িঘড়ি দেখে মনে হচ্ছিল শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানানো নিয়ে তাঁরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং জু নির্বাচনের পরের দিনই প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বার্তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যান এবং সেখানে বঙ্গবন্ধুকে তিনি ‘মহান বিশ্বনেতা’ হিসেবে উল্লেখ করেন। রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং জু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে যে নৌকার মডেলটি তুলে দিয়েছেন, সেটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায় রাতারাতি বানানো ছিল না। এতে বোঝা যায়, নির্বাচনের ফল কী হতে যাচ্ছে, তা চীন আগেভাগেই অনুমান করতে পারছিল। চীন নির্বাচনের আগে থেকেই বাংলাদেশে সামাজিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পক্ষে কথা বলে যাচ্ছিল। বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ নিশ্চিত এবং এখানে দেশটির বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ ফ্রেমওয়ার্ক ঠিক রাখতে বিদ্যমান স্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকা বেইজিংয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ক্ষমতাসীন দল প্রায় সব আসন এমনভাবে করায়ত্ত করেছে, যা দেখে মনে হয়, যেন চীন যে উন্নয়ন মডেলের পক্ষে কথা বলে থাকে, আওয়ামী লীগ সরকার সেই মডেলকে গ্রহণ করে নিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক ব্যর্থতার কারণ হিসেবে চীন বরাবরই উদারপন্থী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দায়ী করে থাকে। ২০১৮ সালে অন্য একটি প্রতিবেদনে গ্লোবাল টাইমস বলেছিল, উন্নয়নশীল দেশগুলো যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, তা সমাধান করতে উদারপন্থী নীতি ও আইডিয়া চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। সেখানে বলা হয়েছিল, অনেক উন্নয়নশীল দেশ পশ্চিমা দেশগুলোর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অনুসরণ করতে গিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। আর ৩ জানুয়ারি ছাপা হওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে উন্নয়নের পথে বহুদলীয় ব্যবস্থা অনেক সময় নেতিবাচক ভূমিকা রাখে।

এ কারণে বলা যায়, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে যে পশ্চিমা গণতন্ত্রের অনুসরণ করে আসছে, তা যদি ভেঙে পড়ে, তাহলে সেটি হবে চীনের বড় ধরনের আদর্শিক বিজয়। আর এ কারণেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্ভাব্য হস্তক্ষেপকে চীন বাংলাদেশকে ঘিরে তার ঠিক করা লক্ষ্য অর্জনের পথে বড় বাধা বলে মনে করে। চীনের ধারণা, নির্বাচনের পর বিরোধীরা যদি পশ্চিমাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে এবং পশ্চিমারা যদি বিরোধীদের সহায়ক শক্তিতে পরিণত হয়, তবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। গ্লোবাল টাইমস–এ গত বছর প্রকাশিত অন্য একটি নিবন্ধে বলা হয়েছিল, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে চীনের উত্থানকে হয়তো পশ্চিমারা ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না, কিন্তু তারা এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

এশিয়ার এই অংশে পশ্চিমাদের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতাকে চীন সতর্কতার সঙ্গে দেখে থাকে। গ্লোবাল টাইমস পত্রিকার একই নিবন্ধে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে নির্বাচন হলেই সেই দেশে নিজ নিজ আধিপত্য বাড়াতে নির্বাচনে অংশ নেওয়া দুই পক্ষে চীন ও ভারত প্রতিপক্ষের মতো ভূমিকা রাখে। এ ক্ষেত্রে বরাবরই যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সব ধরনের সহযোগিতা করে থাকে; কারণ, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র চায় না চীন দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে তার আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পাক। ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, চীন দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশের নির্বাচনকেই তার জন্য নিষ্ফল নির্বাচন মনে করে না। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট হয়ে ভারতের আধিপত্য বিস্তারকেও চীন নিজের জন্য হুমকি মনে করে।

চীন মনে করে, বাংলাদেশে বিরোধীদের আন্দোলন ও সহিংসতা পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপকে ন্যায্যতা দেবে। যদি সেই বিক্ষোভ ও সহিংসতার অনুপস্থিতি দেখা যায়, তাহলে চীন ধরেই নিতে পারে এখানে পশ্চিমাদের প্রভাব খুব একটা আর নেই। হয়তো সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চীন সরকারবিরোধীদের আলোচনার টেবিলে আনার বিষয়ে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, যাতে বিরোধীরা সংঘাত থেকে দূরে থাকে। ঠিক একই কারণে চীন বিরোধীদের ‘রাজনৈতিক হানাহানি’ বাদ দিয়ে জনগণের কল্যাণে কাজ করার জন্য তাগাদা দিচ্ছে।

বাংলাদেশের রূপান্তরের পথে ধাবমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতে নিজেদের বিনিয়োগ জারি রাখতে চীন চায় বাংলাদেশে রাজনৈতিক মেরুকরণ কমুক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকুক। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিবর্তনের দিকে যাওয়াকে ত্বরান্বিত করতে চীন নানা ফর্মে এখানে বিনিয়োগ করছে। অবকাঠামো উন্নয়নে তাদের সরাসরি বিনিয়োগ আছে। উৎপাদন খাতেও তাদের বিনিয়োগ আছে। চীনে বাংলাদেশের অনেক পণ্যের শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশের আলোচনাও চলছে। শিগগিরই সে বিষয়টি নিশ্চিত হবে।

ডেইলি স্টার–এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ আছে ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের বেশি। এই অর্থের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতামূলক অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ আছে ২ হাজার ৪৪৫ কোটি ডলার এবং যৌথ উদ্যোগী খাতে বিনিয়োগ আছে ১ হাজার ৩৬০ কোটি ডলার। এ ছাড়া ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ঢাকা সফর করার পর ২ হাজার কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশকে আগে কখনোই একসঙ্গে এত অর্থসহায়তা অন্য কোনো দেশ দেয়নি।

বাংলাদেশে চীনের এই বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণকে কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, বর্তমান সরকার উন্নয়নকেই তার ক্ষমতায় টিকে থাকার মূল যুক্তি হিসেবে বলে আসছে। এর বাইরে চীনের পক্ষেই এককভাবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করা সম্ভব। চীন চাইছে, চীনের সহায়তা নিয়ে শেখ হাসিনা এই ঐতিহাসিক সুযোগটি নিক। একই সঙ্গে এই অঞ্চলে পশ্চিমা ও তাদের মিত্রদের তৎপরতা কমানোয় ভূমিকা রাখাও উচিত হবে। বিরোধী রাজনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা করে তঁাদের নিয়ে একটি ঐক্য গড়ে তোলার মাধ্যমেই এটি সম্ভব।  

ইংরেজি থেকে অনূদিত

ড. খলিল উর রহমান জাতিসংঘ মহাসচিবের নির্বাহী দপ্তরের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও উন্নয়নবিষয়ক সাবেক প্রধান