সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে স্থবিরতা কেন?

সাগরবক্ষে গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশ সফলতা অর্জন করতে পারেনি
সাগরবক্ষে গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশ সফলতা অর্জন করতে পারেনি

বঙ্গোপসাগরের নিচে ব্যাপক গ্যাস ও তেলসম্পদ আবিষ্কার ইতিমধ্যেই ভারত ও মিয়ানমারকে বিশ্বের বড় বড় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বঙ্গোপসাগরে ভারত ও মিয়ানমারের অংশে সম্পদ আহরণের কর্মযজ্ঞ দেশ দুটিকে গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পেছনে পড়ে রয়েছে বাংলাদেশ। অথচ সাগরের সার্বভৌম অধিকার আদায়ে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীদের তুলনায় ছিল সোচ্চার, চৌকস ও কার্যকর।

২০০১ সালের পর ভারতের সমুদ্রে, বিশেষ করে গভীর সমুদ্রে বড় আকারের গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার এবং প্রায় একই সময়ে মিয়ানমার সমুদ্রে বড় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার বঙ্গোপসাগরকে গ্যাসসমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে পরিচিত করে। তখন বাংলাদেশ তার সমুদ্রে অনুসন্ধানকাজ করতে গেলে পূর্বে মিয়ানমার ও পশ্চিমে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সমুদ্র সীমানা নিয়ে বিবাদ তুলে কাজে বাধার সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়। ২০০৯ সালে নবনির্বাচিত বাংলাদেশ সরকার সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়ার একটি সাহসী পদক্ষেপ নেয়। আন্তর্জাতিক আদালত ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানা চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করে রায় দেয়। প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে সমুদ্রসীমানার চিরস্থায়ী সমাধান দেশের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি অনন্য ঘটনা। এর ফলে তিনটি দেশই তাদের নিষ্কণ্টক সমুদ্রসীমানায় নিজস্ব কর্মযজ্ঞ চালানোর পরিবেশ ফিরে পায়।

২০১৩ সালে মিয়ানমার তার সমুদ্র ব্লকগুলো চিহ্নিত করে প্রাথমিকভাবে মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে সম্পন্ন করে এবং আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে প্রতিযোগিতামূলকভাবে আমন্ত্রণ জানানোর উদ্যোগ নেয়। ২০১৪ সালে ১০টি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি মিয়ানমার সমুদ্রে উৎপাদনে অংশীদারত্ব চুক্তির অধীনে অনুসন্ধানকাজ শুরু করে। এতে কাঙ্ক্ষিত সফলতা লাভ করতে শুরু করে এবং সমুদ্রের গ্যাস আহরণের কার্যক্রম হাতে নেয়। এদিকে ভারতও তার সমুদ্রবক্ষে নিজস্ব খনন চালানো ছাড়াও আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির সহায়তাকে কাজে লাগিয়ে সাগরের গ্যাস সম্পদ আহরণে যথেষ্ট সফলতা লাভ করে।

বাংলাদেশ সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর তার সমুদ্র ব্লকগুলোকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করে ২৬টি ব্লকে ভাগ করে, যার মধ্যে ১১টি অগভীর (পানির গভীরতা ২০০ মিটার পর্যন্ত) এবং ১৫টি গভীর (পানির গভীরতা ২০০ মিটারের বেশি)। মোট ২৬টি ব্লকের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ৪টি ব্লক বিদেশি তেল কোম্পানির অধীনে চুক্তিবদ্ধ রয়েছে। বাকি ২২টি ব্লক উন্মুক্ত ও কর্মশূন্য। ২০১৪ সালে পেট্রোবাংলা সাগরবক্ষে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করার জন্য প্রাথমিকভাবে মাল্টি ক্লায়েন্ট সাইসমিক সার্ভে করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তা অজ্ঞাত কারণে সম্পন্ন করা হয়নি। অথচ এর অভাবে দেশের সমূহ সম্ভাবনাময় সাগরবক্ষে জোরালো গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করা যায়নি।

মাল্টি ক্লায়েন্ট সিসমিক সার্ভে বা জরিপ করা বিশ্বের প্রায় সব দেশেই একটি প্রতিষ্ঠিত পন্থা, যার মাধ্যমে একটি দেশ তার সমুদ্রের মাটির নিচে ভূতাত্ত্বিক গঠন ও সম্ভাবনার প্রাথমিক ধারণা পেতে পারে। এই সাইসমিক জরিপে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে একটি দেশ আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিকে অনুসন্ধানকাজে আকৃষ্ট করতে পারে এবং তাদের সঙ্গে চুক্তি করার সময় নিজস্ব স্বার্থ অনুযায়ী দর-কষাকষি করতে পারে। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী মাল্টি ক্লায়েন্ট সাইসমিক সার্ভে কাজ করতে বিশেষায়িত বহুজাতিক সার্ভিস কোম্পানিকে নিয়োগ করা হয় এবং নিয়োজিত কোম্পানি তা বিনা মূল্যে করে দেয়। সার্ভিস কোম্পানি এই জরিপে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যে ‘ডেটা প্যাকেজ’ তৈরি করে তা দেশটিতে অনুসন্ধানে আসতে আগ্রহী আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির কাছে বিক্রি করে। এভাবে সার্ভিস কোম্পানি তার জরিপ খরচ ওঠানোর পর লভ্যাংশ সে দেশটির সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়। একটি দেশ তার সমুদ্রবক্ষে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিকে দিয়ে অনুসন্ধান করাতে চাইলে ওই সমুদ্রের প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত (ডেটা প্যাকেজ) দেখিয়ে কোম্পানির আগ্রহ গড়ে তুলতে না পারলে সেখানে সাধারণত বিদেশি কোম্পানি ব্যয়বহুল অনুসন্ধানে অংশ নিতে অনাগ্রহী হয়।

বাংলাদেশ নিজের সমুদ্রে ২০১৪ সালে মাল্টি ক্লায়েন্ট সাইসমিক সার্ভে করার উদ্যোগ নিলেও কেন শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি তা সাধারণভাবে জানা যায় না। তবে এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে ধূম্রজালের ইঙ্গিত মেলে। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পেট্রোবাংলা সাগরে মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে করার জন্য দরপত্র আহ্বান করে। পাঁচটি আন্তর্জাতিক কোম্পানি আবেদন করার পর যাচাই-বাছাই করে সবচেয়ে যোগ্য কোম্পানি নির্ধারণের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কারিগরি কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞ কমিটির নির্ধারণ করা কোম্পানির নাম নিয়ম অনুযায়ী পেট্রোবাংলা তা অনুমোদনের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর অনুমোদন বা সিদ্ধান্ত না আসায় পেট্রোবাংলার তরফে তাগাদাও দেওয়া হয়। কিন্তু একসময় এ প্রস্তাব অনুমোদন না করেই তা পেট্রোবাংলায় ফেরত পাঠানো হয়। অনুমোদন না দেওয়ার কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি।

পেট্রোবাংলা ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে আবার আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে। আবারও কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটি যাচাই-বাছাই করে যোগ্য প্রার্থী নির্ধারণ করে এবং আগের মতো অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়। এবারও একইভাবে দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর অনুমোদন ছাড়াই পেট্রোবাংলায় ফেরত আসে। বিশেষজ্ঞ কমিটির সিদ্ধান্তকে বারবার অগ্রাহ্য করা এবং কোনো কারণ দেখানো ছাড়া অনুমোদন না দেওয়ার ঘটনা খুব স্বাভাবিকভাবেই সংশ্লিষ্ট মহলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, বিশেষজ্ঞ কমিটি দ্বারা নির্বাচিত যোগ্য কোম্পানি কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নিজস্ব পছন্দের না হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের উচ্চমহলে প্রভাব খাটিয়ে সেটি আটকানো হয়েছে। এর ফলে দেশের সমুদ্রবক্ষে অতি প্রয়োজনীয় মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে করার বিষয়টি আটকে যায়।

এরপর মন্ত্রণালয় থেকে একটি নতুন প্রস্তাবে বলা হয় যে সাগরে কাজ করার জন্য বাংলাদেশ নিজস্ব একটি জাহাজ কিনবে এবং সাগরে প্রয়োজনীয় জরিপকাজ তা দিয়েই করা হবে। দেশের অভিজ্ঞ মহলের কাছে প্রস্তাবটি অবাস্তব ও অপরিপক্ব চিন্তাপ্রসূত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন যে সাইসমিক সার্ভে করার জন্য বিশেষায়িত জাহাজ কিনে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে বহু সময় লাগবে। এ বিষয়টি বুঝে উঠতেও সংশ্লিষ্টদের বছরখানেক সময় চলে যায়। এরপর আরেক প্রস্তাবে বলা হয় যে বাংলাদেশ নিজের অর্থ খরচ করে জাহাজ ও জনবল ভাড়া করে সাগরে অনুসন্ধান জরিপের মাধ্যমে ডেটা প্যাকেজ তৈরি করবে। কিন্তু সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের প্রচলিত পদ্ধতি মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে যেখানে নিজস্ব বিনিয়োগ ছাড়াই করা যায় ও চুক্তিবদ্ধ কোম্পানির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিকে সাগরের সম্ভাবনা সম্পর্কে আগ্রহান্বিত করে তোলা যায়, সে ক্ষেত্রে অপরীক্ষিত এই পদ্ধতি বিবেচনায় আনা অযৌক্তিক।

ওপরের ঘটনা থেকে এটা পরিষ্কার যে সাগরবক্ষে গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি নিয়োজিত করার লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত বা ডেটা প্যাকেজ তৈরি করার প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত পথকে জটিল, বিতর্কিত ও অকার্যকর করে ফেলা হয়েছে। আর এর ফলে আটকে গেছে সাগরের গ্যাস অনুসন্ধান। এর নেপথ্যে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ কাজ করছে বলে মনে করা হয়।

জনমনে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে সম্ভাবনাময় সাগরবক্ষে গ্যাস সন্ধানে কেন এই স্থবিরতা? সমুদ্রসীমানার ঠিক ওপারে ভারত ও মিয়ানমার গ্যাস উত্তোলনে যেভাবে সফল, বাংলাদেশ কেন সেই সফলতা অর্জন করতে পারেনি। দেশের গ্যাস-সংকটের এই দুর্দিনে সাগরের গ্যাসই হতে পারে রক্ষাকবচ। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সচেতন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সাগরের গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ অনতিবিলম্বে শুরু করার ব্যাপারে সরকারের তরফে উদ্যোগ আশা করছি।

ড. বদরূল ইমাম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ