ব্যাংক খাতে সুশাসন ও শৃঙ্খলা জরুরি

যুক্তরাষ্ট্রের সাব–প্রাইম মর্টগেজ মার্কেটে আগ্রাসী ঋণচর্চার কারণে সৃষ্ট আবাসন খাতে বুদ্‌বুদ (বাবল) এবং আর্থিক খাতের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনাই ২০০৭ সালের বৈশ্বিক আর্থিক ও অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টির পেছনে কাজ করেছিল। ওই আর্থিক সংকট ছোঁয়াচে রোগের মতো মার্কিন অর্থনীতির আবাসন খাতে দ্রুত বিস্তার লাভ করে বিশ্বের আর্থিক ও উৎপাদনশীল উভয় খাতেই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এভাবে ওই সংকট বৈশ্বিক রূপ নেয় এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়।

ওই বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার মূল কারণ হিসেবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থাপনাকেই চিহ্নিত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশ নানা ব্যবস্থা নেওয়ার পরও বিশ্ব অর্থনীতির পুরোপুরি পুনরুদ্ধার এখনো সম্পন্ন হয়নি। তাই আগামী বছরগুলোও বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। বাংলাদেশের মতো ছোট অর্থনীতির দেশগুলো বৃহৎ অর্থনীতির নেতিবাচক নীতিগুলোর বাইরে নয়। সুতরাং বাংলাদেশকেও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। জি-২০সহ অন্যান্য ফোরামে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে পুনরুদ্ধারের অংশ হিসেবে স্থিতিশীলতা আনয়নে অগ্রাধিকার যেমন দিতে হবে, তেমনি লক্ষণগুলো (ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারিতে ঘাটতি) আমলে নেওয়ার সঙ্গে অন্তর্নিহিত কারণগুলোও (দুর্বল নীতি, সাধারণ ব্যাংকিং নীতিমালা এবং ব্যবস্থাপনা মানদণ্ড কার্যকরে শৈথিল্য, অস্বচ্ছ আর্থিক প্রতিবেদন, বুদ্‌বুদ সৃষ্টিকারী তারল্যের লাগামহীন বিস্তৃতি) বিবেচনায় নিতে হবে।

নিজ অর্থনীতির বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ আঘাত প্রশমনে বাংলাদেশের করণীয় কী?

সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে সংঘটিত (হল-মার্ক, বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ) আর্থিক কেলেঙ্কারি ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় চিড় ধরিয়েছে। পরিচালনা পর্ষদ থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা স্তরের নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ কেউ এসব ব্যাংকে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি দেখাতে পারেনি। উদ্বেগের বিষয়, এসব অনিয়ম বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে।

ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। বর্তমানে এই খাতের প্রথম সমস্যা সুশাসনের অভাব। দ্বিতীয় সমস্যা এ খাতের জন্য প্রণীত নীতিমালা ও আইনকানুন, কোম্পানি আইন, আন্তর্জাতিক নীতিমালা ইত্যাদি সঠিকভাবে পরিপালন করা হচ্ছে না। এগুলো আন্তর্জাতিক মানের, কিন্তু এগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপক ও নিচের কর্মকর্তা পর্যায়ে কোথাও সুশাসন নেই, সর্বত্রই মারাত্মক ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতের অবস্থা এখন মোটেও ভালো নয়।

বিশেষত রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় সমস্যা সবচেয়ে প্রকট। পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সার্বিক নির্দেশনা দেবে, নীতিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে আর ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা নীতিমালা বাস্তবায়ন করবেন, এটাই নিয়ম। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কার্যপরিধি আইন দিয়ে নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায়, পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কাজে হস্তক্ষেপ করে। এখন দেখা যায়, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নীতিগত সিদ্ধান্ত দেওয়ার চেয়ে ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করতেই যেন বেশি উৎসাহী। ফলে ব্যাংক ব্যবস্থাপকদের পক্ষে স্বাধীনভাবে সৃজনশীলতা কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। তারা প্রায়শ পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই ব্যাংক সেক্টরের জন্য মঙ্গলজনক নয়। অবশ্য ব্যাংক ব্যবস্থাপনাও যে সব সময় দক্ষ হয়, তা নয়। অনেক সময় ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও ত্রুটির কারণেও সমস্যা সৃষ্টি হয়।

এসব নানা কারণে ব্যাংক খাতে দুর্নীতি দেখা দিচ্ছে, জবাবদিহির ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে পরস্পরকে দোষারোপ করার প্রবণতা দেখা যায়। ফলে জবাবদিহির বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়ে। ব্যাংক খাতে নজরদারি ও তদারকিও খুব দুর্বল। যাঁরা পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান বা পরিচালক হয়ে আসেন, তাঁদের নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্য থাকে। তাঁরা আত্মীয়স্বজনের ব্যবসা-বাণিজ্যে সুবিধা দেওয়ার জন্যও ব্যাংক ম্যানেজমেন্টকে চাপ দেন। নিজের লোকদের ঋণ বা চাকরি দেওয়ার জন্য তাঁরা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর প্রভাব খাটান। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আগে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় এমনটি ছিল না।

ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যাঁরা নিয়োগ লাভ করেন, তাঁদের নিযুক্তি অনেকটাই নির্ভর করে পরিচালনা পর্ষদের ওপর। কাজেই তাঁরা ইচ্ছা করলেই পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বা চেয়ারম্যানের পরামর্শ বা নির্দেশনা উপেক্ষা করতে পারেন না। কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি কোনো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে থাকবেন কি থাকবেন না, তা অনেকটাই নির্ভর করে ওই ব্যক্তির ওপর পরিচালনা বোর্ডের সদস্যদের সন্তুষ্টির ওপর। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দক্ষতা ও কাজের সাফল্যের ওপর তাঁর টিকে থাকা, না–থাকা তেমন একটা নির্ভর করে না। পরিচালনা পর্ষদে অনেকেই থাকেন, যাঁরা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। রাজনৈতিক প্রভাব বহুলাংশে দক্ষ ও সৎভাবে ব্যাংক পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করে।

পরিচালকদের অনেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চান। একজন পরিচালক বা চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতেই পারে; কিন্তু তা যদি ব্যাংকের কাজে ব্যবহার করতে চান, তাহলেই সমস্যা দেখা দেয়। ব্যবস্থাপনার মধ্যেও অনেকে আছেন, যাঁরা দক্ষ নন, রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যদি অদক্ষ বা দুর্বল হন, তাহলে এর প্রভাব সর্বত্রই পড়ে। এতে নিচের দিকের কর্মীরা নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। দুর্নীতি-অনিয়ম ওপর থেকে নিচের দিকে ধাবিত হয়। কাজেই টপ ম্যানেজমেন্ট যদি কঠোরভাবে সুশাসন নিশ্চিত করে, তাহলে তার প্রভাব নিচের দিকে পড়বেই। কিন্তু আমাদের এখানে টপ ম্যানেজমেন্টের মধ্যেও সমস্যা রয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরে এখন সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা জেঁকে বসেছে।

ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার মধ্যে অবশ্যই ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোকে একদম ছেড়ে দেওয়া যাবে না, আবার তাদের অধিক নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এতে বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে। আমাদের আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের প্রধান উদ্দেশ্য আমানতকারী, গ্রাহক ও সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করা; সামগ্রিকভাবে প্রকৃত অর্থনীতিকে (প্রকৃত সেবা দিয়ে) উন্নত করা। নিয়ন্ত্রণের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পদ্ধতিগত ঝুঁকি কমানো, যাতে তা অর্থনৈতিক ভিত্তি ভেঙে গিয়ে প্রকৃত উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি হ্রাস, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং মানবকল্যাণের ক্ষেত্র সংকুচিত হতে না পারে।

ব্যাংক খাতে বিরাজমান সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে সুশাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সরকারি-বেসরকারি দায়িত্ব বিবেচনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি সম্প্রতি আরও উদ্বেগের কারণ হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সংজ্ঞায়, স্বচ্ছতা হলো এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি, যেখানে মুদ্রা ও আর্থিক নীতি–সম্পর্কিত সব তথ্য সময় সময় জনগণকে বোধগম্য উপায়ে জানানো হয়। সামষ্টিক অর্থনীতিতে টেকসই সুশাসন ও সার্বিক আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারি কার্য পরিচালনায় স্বচ্ছতা বিধান পূর্বশর্ত। জবাবদিহি হলো পারস্পরিক চুক্তির ভিত্তিতে বিদ্যমান সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারি বা বেসরকারি কোনো এজেন্ট কর্তৃক সুলভে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান। আর্থিক বাজারে অংশগ্রহণকারী প্রধান গোষ্ঠী ঋণদাতা-ঋণগ্রহীতা, ব্যাংক-বিমা প্রতিষ্ঠান, বিনিয়োগকারী, জাতীয় কর্তৃপক্ষ, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান সবার জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করতে স্বচ্ছতা প্রয়োজন। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি পরস্পর সম্পর্কিত। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে নজরদারি বাড়ে। আবার জবাবদিহি থাকলে স্বচ্ছতা বাড়ে, এটা সবার জন্য উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করে। সবাই নিশ্চিত হয় যে মানুষ তাদের কাজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জেনেছে এবং বুঝেছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতির যথার্থ উদাহরণ হচ্ছে ব্যাংকে সংঘটিত হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি। সেখানে ঋণগ্রহীতা ও কর্মকর্তারা গোপন সমঝোতার মাধ্যমে অস্বচ্ছ উপায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিলেন। সে ঘটনায় যাঁদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তাঁদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা ‘বিকৃত প্রণোদনা’ পেয়েছেন এবং একই ব্যাংক ও অন্যত্র যেসব সৎ কর্মকর্তা কাজ করেন, তাঁদের অবহেলা করে পেছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এ যেন মন্দ অর্থ ভালো অর্থকে বিতাড়িত করা।

সুশাসনের লক্ষ্য ও বিধিমালা পরিপালনের মধ্যে ভারসাম্য আনতে ব্যাংক খাতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি: ক. মৌলিক ব্যাংকিং কার্যক্রমে মনোযোগ নিবদ্ধ করার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও শক্তিশালী ও স্বাধীন করা।খ. সুচিন্তিত ও সুবিবেচনাপ্রসূত আর্থিক ও ব্যবস্থাপনা মানদণ্ড নির্ধারণ করা, যা কখনো রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপের কারণে পরিবর্তিত হবে না; এবং গ. সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে দ্রুত সংশোধনের ব্যবস্থা, সুনির্দিষ্ট ব্যাংকে বা সামগ্রিক ব্যাংক ব্যবস্থায় সংকটের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত দৃশ্যমান আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক