ধ্বংসের পানে ছুটে চলা

গণিত অলিম্পিয়াড, বিজ্ঞান, প্রোগ্রামিং, তারুণ্যের জয়োৎসবসহ নানা আয়োজন এবং কারণে আমি প্রায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, শহরে হাজির হই। আমি আনন্দের সঙ্গে এসব অনুষ্ঠানে যোগ দিই। কারণ, এটি আমার ভালো লাগে। দ্বিতীয়ত, আমি কোনো কাঠামোর বাইরে গিয়ে 

আমাদের এক প্রজন্মের বেড়ে ওঠার সাক্ষীও হতে পারি। বেশির ভাগ সময়ই আমি ভালো মনে, নতুন অনুপ্রেরণা নিয়ে ঘরে ফিরে আসি। কিন্তু কখনো কখনো মনটা বেদনায় ভারাক্রান্ত থাকে।

কদিন আগে ঢাকার পার্শ্ববর্তী একটি জেলা শহরে গিয়েছিলাম। সেখানে স্কুলশিক্ষার্থীদের সঞ্চয়সংক্রান্ত একটি আয়োজন ছিল। ৩০টি স্কুলের প্রায় ৮০০ শিক্ষার্থী সে আয়োজনে যোগ দিয়েছে। সেখানে একটি স্টেজ কুইজ আর একটি কুইজ পরীক্ষা ছিল। ওই দুটির পারফরম্যান্স দেখে আমার মনটা খারাপ হয়েছে। স্টেজ কুইজে প্রতিটি স্তরে যারা পারবে না তারা ঝরে যাবে, এটা ছিল নিয়ম। সেখানে একসঙ্গে সাতজন ঝরে পড়ার প্রশ্ন ছিল গণিতের একটি সমস্যা। সমস্যাটি ছিল কতগুলোর সংখ্যার গুণফল বের করা, যেখানে সংখ্যাগুলোর একটি ছিল শূন্য (০)! স্বাভাবিকভাবে এটির গুণফল শূন্যই হবে। কিন্তু হাইস্কুলের সাতজন পড়ুয়া এর কোনো না কোনো মান বের করার কারণে ঝরে পড়েছে!

আমার মনে পড়েছে, গণিত অলিম্পিয়াডের শুরুর দিকে এমন একটি অঙ্ক আমরা শিক্ষার্থীদের করতে দিতাম। এখন আর দিই না, কারণ এখন যারা গণিত অলিম্পিয়াডে আসে—তারা এসব সাধারণ প্রশ্নে কাবু হয় না। এ প্রতিযোগিতার প্রথম তিনজন থেকে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার প্রশ্নটি ছিল ‘১০০–এর ৫% কত?’। সেরা তিনের মধ্যে মাত্র একজন এই প্রশ্নের জবাব দিতে পেরেছে। আমি খুব নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, ওই দিন ওই অনুষ্ঠানে যারা ছিল তাদের কমবেশি সবাই আগের পাবলিক পরীক্ষায় হেসে-খেলে জিপিএ–৫ পেয়েছে।

এই পরীক্ষার ফলাফল দেখে আমি অবশ্য ততটা চমকাইনি। যতটা হতাশ হয়েছি কুইজ পরীক্ষার সময় সেখানকার উপস্থিত শিক্ষক ও অভিভাবকদের কাণ্ড দেখে। ওই দিনের কুইজ পরীক্ষায় প্রশ্ন ছিল ২০টি করে, সব প্রশ্নই বহুনির্বাচনি। চারটি অপশন থেকে সঠিকটি নির্বাচন করাই কাজ। সহজ প্রশ্ন, বাংলাদেশের স্থপতি কে বা অর্থমন্ত্রীর নাম। আবার এক–দুটি একটু জটিল গণিতও। সব শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষক আছেন, অনেকের সঙ্গে আছেন মা–বাবা। যেহেতু শিক্ষক-অভিভাবক থাকবেন সঙ্গে, পরীক্ষা হবে অডিটরিয়ামে। একদমই উন্মুক্ত থাকবে সব। ইন্টারনেট, কথা বলা, কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। আমাদের সে রকম ইচ্ছেও ছিল না। আমরা কেবল চার সেট প্রশ্ন করেছি, তবে সেটা কোথাও বলিনি। প্রতিটি সেটের প্রথম পাঁচটি প্রশ্ন হুবহু একই। মানে কেউ যদি দুই সেট প্রশ্ন হাতে নেয়, শুরু দেখে কিছুতেই বুঝতে পারবে না ভেতরে কোনো পরিবর্তন আছে
কি না। ৬ নম্বর থেকে প্রশ্ন এবং তার অপশন উল্টেপাল্টে দেওয়া হলো।

পরেরটুক আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডের একাডেমিক কাউন্সিলর ইবরাহিম মুদ্দাসসেরের কথায় বর্ণনা দিচ্ছি, ‘আমরা যখন প্রশ্ন দিচ্ছিলাম, শিক্ষার্থীদের চেয়ে প্রশ্ন নেওয়ায় আগ্রহ বেশি দেখালেন শিক্ষকেরা, অভিভাবকেরা। শিক্ষার্থীরা অনেকে আলোচনা করে, দেখাদেখি করে উত্তর করতে চেষ্টা করল। কিন্তু শিক্ষকেরা কী করলেন? একেক দল একেক রকম ঘটনা ঘটালেন। কয়েকটা বলা যাক।

‘এক স্কুলের দু–তিনজন শিক্ষক, মোবাইল-ইন্টারনেট দেখে প্রশ্ন সমাধান করছেন। তাঁদের সঙ্গে কোনো শিক্ষার্থী নেই। প্রশ্নগুলোর সমাধান হলে স্কুলের সব শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে বলে দিলেন, ১-এর উত্তর খ, ২-এর উত্তর ঘ, ১৯-এর উত্তর গ, ইত্যাদি ইত্যাদি। আরেক দল শিক্ষার্থীকে সঙ্গে নিয়ে একই সঙ্গে সমাধান করতে লাগলেন। তিনি মাঝখানে আদর্শ কোচের ভূমিকা নিলেন। সবাই প্রশ্ন করছে, তিনি বা তাঁরা উত্তর বলে দিচ্ছেন। না পারলে উত্তর খুঁজছেন ইন্টারনেটে।

‘একদলকে দেখলাম, স্যাররা নিজেরাই সমাধান করেছেন, ওপরে নাম লিখে দিয়েছেন কোনো শিক্ষার্থীর। খুব সম্ভবত তাঁর কাছে প্রাইভেট পড়া কোনো শিক্ষার্থীর নাম। ওই শিক্ষার্থী ওই খাতায় হাতই দেয়নি। উত্তরপত্র জমা দেওয়ার সময় নিজেই আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।

‘শুধু শিক্ষক নন, অভিভাবকেরাও পিছিয়ে থাকতে চাননি। দেখলাম, তিনজন অভিভাবক দাঁড়িয়ে প্রশ্নের সমাধান করছেন। বয়সে ছোট সিক্স-সেভেনে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী তিনজনের ফাঁক গলে মাথা ঢুকিয়ে একটু দেখার চেষ্টা করছে তার নামে কী উত্তর করছেন তারই অভিভাবক। বেচারা!’

এতটুকু পড়ে অনেকে নিশ্চয়ই ভাবছেন আমাদের সেদিন ৪০ জন বিজয়ী বের করতে অনেক সমস্যা হয়েছে। কিন্তু তা হয়নি। কারণ, সেকেন্ডারিতে ২০–এর মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে ১৪। জুনিয়রে সর্বোচ্চ ১৬। অধিকাংশই পেয়েছে ৬ বা ৭। তিনজন শিক্ষক মিলে ইন্টারনেট ঘেঁটে ওই সবগুলো প্রশ্নের সমাধান কেউ করতে পারেননি?

ছোটবেলা থেকে শিক্ষার্থীদের জিপিএ–৫–এর পেছনে দৌড়িয়ে আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি? আমরা কি ভাবছি এ ইঁদুর দৌড় তাদের সত্যিকারের মানুষ করতে পারবে? এই শিশুরা যখন বড় হবে, কর্মবাজারে প্রবেশ করবে, তখন তাদের একটা বড় কাজ হবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কর্মী ও রোবটদের সঙ্গে লড়াই করা। তারা কি সেটা পারবে?

আগামী ২৩ বছরে আমরা আমাদের অর্থনীতিকে ১৩ গুণ বড় করতে চাই, যেতে চাই উন্নত বিশ্বের কাতারে।

ভাবছেন এই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সেখানে পৌঁছাতে পারবেন!

মুনির হাসান, প্রথম আলোর যুব কর্মসূচির সমন্বয়ক