সংসদ ও নির্বাচন: বর্জনে অর্জন কী হবে?

বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র অপূর্ণাঙ্গ। সংসদ প্রাণহীন
বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র অপূর্ণাঙ্গ। সংসদ প্রাণহীন

গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল সবার জানা। এখানে সরকারের প্রকৃত বিরোধী পক্ষ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মাত্র আটটি আসন লাভ করেছে। এর মধ্যে মূল শরিক বিএনপির ছয়টি। অবশিষ্ট আসনের সিংহভাগ গেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাতে। ২১টি আসন নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে জাতীয় পার্টি। আর ১৪-দলীয় জোটের শরিক দলগুলোও পেয়েছে কয়েকটি আসন। জাতীয় পার্টি ও ১৪ দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে একজোট হয়ে নির্বাচন করেছে। অনেকটা মহাজোটের মতো। কিন্তু এবারের মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন শুধু আওয়ামী লীগের সদস্যরাই। জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের অন্য সহযোগী আইনপ্রণেতাদের প্রত্যাশা ছিল মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়া। জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে গেছে। আর ১৪ দলের ছোট শরিকদেরও বাধ্য হয়ে অনুসরণ করতে হচ্ছে সে পথ। তবে নির্বাচনের মাঠে তারা সবাই ঐক্যফ্রন্টের বিরুদ্ধে ছিল।

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোসহ বিভিন্ন তরফে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তোলা হয়েছে। তবে সরকার গঠন হয়ে গেছে। আজ ৩০ জানুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন। ঐক্যফ্রন্টের আটজন ছাড়া অন্য সাংসদেরা শপথ নিয়েছেন। তাদের সাংসদেরা শপথ নেবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট। এ ঘোষণার কোনো ব্যত্যয় না ঘটলে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আসনগুলো শূন্য হয়ে যাবে। সেখানে হবে উপনির্বাচন। এখানে প্রশ্ন থাকে ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনের প্রকৃতি সম্পর্কে যত অভিযোগই করুক, তারা এর প্রতিকারের দ্রুত কোনো আশা করতে পারে না।

বিএনপির ২০১৪-এর নির্বাচনে না যাওয়া এবং তখনকার একটি হিংসাশ্রয়ী আন্দোলনের পর থেকে অনেকটা বিধ্বস্ত। তাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বহুসংখ্যক মামলা ঝুলছে। নিয়মতান্ত্রিক সভা-সমাবেশও বাধার মুখে পড়ে। নির্বাচন উপলক্ষে সংগঠনটি কিছুটা চাঙা হতে পারবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু একদিকে সরকারের বাধা, অন্যদিকে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের তৎপরতায় ভাটার টান সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয় হয়েছে। এ অবস্থায় তাদের অভিযোগের পক্ষেও মাঠে কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। সহসাই তেমন কিছু ঘটবে, এর কোনো লক্ষণ নেই। সে ক্ষেত্রে অনেকে প্রশ্ন করছেন, তারা সংসদে যাবে না কেন? সেখানে গেলে ভবিষ্যতে তারা সক্ষমতা অর্জন করলে মাঠের আন্দোলনও করতে পারবে।

অন্যদিকে নির্বাচন নিয়ে যে কথাগুলো এখন ছোটখাটো সমাবেশ বা গণমাধ্যমে বলছে, সেসব কথা সংসদ অধিবেশনেও বলতে পারবে। আমাদের সমস্যা সংসদে বিএনপি না গেলে সেখানে প্রকৃত কোনো বিরোধী দল থাকবে না। অনেকটা দশম সংসদেরই রূপ নেবে এর কার্যক্রম। অথচ একটি কার্যকর সংসদ পেতে হলে কার্যকর বিরোধী দলও জরুরি। তাদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হলে ভালো হতো। তবে আটজনেও অনেক কিছু করা যায়। ১৯৭২ সালে গণপরিষদে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা—এ দুজন সদস্য ছিলেন বিরোধী দলে। তাঁরা প্রকৃতপক্ষেই গণপরিষদের কার্যক্রমে নিবিড়ভাবে অংশ নিয়ে অনেকের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছিলেন। সংসদে গেলে নিরাপদ স্থানে সরকারের ব্যয়ে বিরোধীরা তাঁদের বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পান। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সংসদ টিভিতেও অধিবেশন সরাসরি সম্প্রচার হয়। ভবিষ্যৎ আন্দোলনের ভাবনা তাদের থাকতে পারে। কিন্তু সংসদ অধিবেশনে যোগ দিলে সেই সুযোগ নষ্ট হয়ে যাবে না।

অবশ্য এর মধ্যে বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে, তারা বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। সামনেই রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনসহ সারা দেশের উপজেলা পরিষদগুলোর নির্বাচন। এসব নির্বাচনে অংশ না নিয়ে কি তারা তাদের সংগঠনকে সক্রিয় রাখতে পারবে? হতে পারে গত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাদের বহুসংখ্যক নেতা-কর্মী কারাগারে। অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য নির্বাচনগুলো বর্জন করলেই কোনো লাভ হবে—এমন তো মনে হয় না। এসব নির্বাচনে রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদল হয় না। ফলে সরকার গত জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় সহনীয় আচরণ করতে পারে। আর একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বলেই তো বলতে পারছে, ‘নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপি হয়েছে।’ এ সুযোগটা হাতছাড়া করা কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত হবে—এটা বিএনপির নেতৃত্ব ভেবে দেখতে পারেন। আর স্থানীয় সরকার নির্বাচন তো কোনো না-কোনো দলীয় সরকারের অধীনে হবে। তাহলে এ ক্ষেত্রে পিছপা কেন? সংগঠনকে সক্রিয় রাখতে এবং বিশেষ করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জোরদার করতে এ বিষয়ে তাদের নতুন করে ভাবনার প্রয়োজন।

আমাদের দেশটির গণতন্ত্রচর্চা বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে মোটামুটি সমালোচনার ঊর্ধ্বে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে পঞ্চম ও সপ্তম সংসদে ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী বিরোধী দল। তা সত্ত্বেও এ চারটি সংসদে যখন যাঁরা বিরোধী দলে ছিলেন, তাঁরা কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করেননি। প্রায়ই করেছেন সংসদ বর্জন। অথচ সবাই নিয়েছেন বেতন-ভাতাসহ সুবিধাদি। কিন্তু জাতিকে দেননি একটি কার্যকর সংসদ। বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র অপূর্ণাঙ্গ। সংসদ প্রাণহীন। জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি তেমন একটা আলোচনায় আসার সুযোগই থাকে না। ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত দেখলাম একই দল থেকে বিরোধী দলের নেতা ও সরকারের মন্ত্রী হতে। মাঠের বিরোধী দল মাঠেই রইল। এবার অবশ্য ঐক্যফ্রন্ট সংসদে গেলেও মূল বিরোধী দল বলে পরিচিত হবে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি। অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত সাংসদেরাই তো সত্যিকারের সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি। তাঁরা তাঁদের মেধা, মনন ও বিচক্ষণতা দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক বক্তব্যের পাশাপাশি জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সংসদে তুলে ধরতে পারেন। এটা তাঁদের জন্য খুব দুরূহ হবে—এমনটা মনে হয় না। বরং গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় রাখবে ইতিবাচক অবদান।

নির্বাচন হয়েছে। হতে পারে এর গুণগত দিক প্রশ্নবিদ্ধ। তবে সরকার গঠিত হয়েছে। আর এ নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দল এখন পর্যন্ত সরকারের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলনে যেতে পারেনি। সুতরাং যা আছে তাকে নিয়ে এগোনো ছাড়া পথ কী? পরে নতুনভাবে নীতিনির্ধারণে তো কোনো বাধা থাকবে না। আর এ দেশে যেভাবেই আখ্যায়িত করা হোক কিংবা পরিণতি যেদিকেই যাক, সব সংসদই কিন্তু একরূপ আইনগত বৈধতা পেয়েছে। বিএনপি সরকারের সময়ে ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে গঠিত সংসদ ও সরকারকে মাসখানেকের মধ্যেই ক্ষমতা ছাড়তে হয়। আর সে সংসদই প্রণীত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে চালু করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। আর সে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কালেই অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। আগের সংসদটি অবৈধ ঘোষণা করার কোনো সুযোগ তাদের ছিল না।

এমনকি ১৯৮৮ সালে এরশাদ যে ভোটারবিহীন নির্বাচন করেন, সে সংসদেই সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ বিচারকদের চাকরির বয়সসীমা ৬২ থেকে ৬৫-তে উন্নীত হয়। ব্যবস্থা হয় হাইকোর্ট বিভাগের কিছু স্থায়ী বেঞ্চ ঢাকার বাইরে স্থাপন করা। শুধু শেষটুকু আদালতের রায়ে বাতিল হয়েছে। প্রধান বিচারপতিসহ বিচারকদের বয়সসীমা পরবর্তীকালে আরও বেড়েছে। আর রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে অনেক বলা হলেও কেউ হাত দেয়নি।

সুতরাং যে সংসদ গঠিত হয়েছে, তারা আইন প্রণয়ন করবে, বাজেট মঞ্জুরি দেবে। এখানে বক্তব্য দিয়ে যতটা জনকল্যাণকর করা যায়, সেদিকেই ঐক্যফ্রন্টের সদস্যরা জোর দিতে পারেন। আর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে পাল্টানো যাবে না—এমনটা নয়। রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। একই বিষয় প্রযোজ্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও। এগুলো বর্জনে কোনো অর্জন হবে না। বরং সংগঠনকে শক্তিশালী করতে অংশগ্রহণই শ্রেয়। আর সত্যিকার অর্থে জাতির প্রয়োজন একটি সক্রিয় বিরোধী দল।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]