শিশু-কিশোরদের পাঠ্যবই

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে গভীর ও জটিল সমস্যাগুলোর একটা হলো পাঠ্যবই রচনা, বিশেষত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের। তথ্যগত ভুল-ত্রুটি, বাক্য গঠন ও বানানে ভুলসহ ভাষাগত অস্পষ্টতা ও দুর্বলতা, ছাপার ভুল, অপটু-অপেশাদারি অলংকরণ, অনাকর্ষণীয় উপস্থাপনা ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হয়। শিশু-কিশোরদের পাঠ্যবইয়ের ভুলত্রুটি, অসংগতি ও নিম্নমান গ্রহণযোগ্য নয়। এগুলো দূর করা অত্যন্ত জরুরি।

প্রশ্ন হলো কীভাবে ও কাদের দ্বারা তা করা সম্ভব। শিশু-কিশোরদের জন্য উৎকৃষ্ট মানের পাঠ্যবই রচনা করার উপযুক্ত মানুষ যদি থেকে থাকেন এবং তাঁদের দ্বারাই যদি কাজটি করানো হয়, তাহলে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে আমরা যে মানের পাঠ্যবই শিশু-কিশোরদের হাতে তুলে দিচ্ছি, তা থেকে প্রশ্ন–সংশয় জাগে যে বাংলাদেশে হয়তো প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই রচনা করার যোগ্য মানুষ কি আছেন? যদি থাকেন, তাহলে এটা নিশ্চিত যে তাঁদের দিয়ে এই কাজটি করানো হয় না। যাঁদের দিয়ে করানো হয়, তাঁরা এ কাজের যোগ্য নন। আর যাঁরা পাঠ্যবইগুলো চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করেন, তাঁদেরও সম্ভবত যোগ্যতার ঘাটতি আছে।

পাঠ্যবই রচনা করা ও সেগুলোর চূড়ান্তভাবে অনুমোদনের দায়িত্ব যাঁদের দেওয়া হয়, তাঁদের যোগ্যতার প্রশ্নটি সরল নয়। তথ্যগত ও ভাষাগত ভুলত্রুটি, দুর্বলতা, অসংগতি, ছাপার ভুল ইত্যাদি কারণেই শুধু পাঠ্যবই নিম্নমানের হয় না। এই সমস্যাগুলো দূর করার পরও পাঠ্যবইগুলো শিশু-কিশোরদের উপযোগী উৎকৃষ্ট মানের হবে না, যদি শিক্ষার মূল ও সামগ্রিক লক্ষ্য সম্পর্কে নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে স্বচ্ছ ধারণার ঘাটতি থেকে যায়।

জীবন ও জগতের প্রতি কৌতূহল ও আগ্রহ জাগানোর মধ্য দিয়ে শিশু-কিশোরদের কল্পনা, সৌন্দর্যবোধ ও সৃজনশীলতার স্বাভাবিক বিকাশে সমর্থন জোগানো ও প্রণোদনা সৃষ্টি শিক্ষার প্রাথমিক লক্ষ্য। সাংস্কৃতিক ও নৈতিক বোধ সৃষ্টিও এই প্রক্রিয়ার অংশ। কাজটি প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে যথোপযুক্ত পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যেই বিদ্যালয়, পাঠ্যবই, পাঠদান ইত্যাদির আয়োজন। কিন্তু তাদের নৈতিকতা শেখানোর কাজটি কিছু প্রচলিত আপ্তবাক্য মুখস্থ করানোর মধ্য দিয়ে করতে যাওয়া নিষ্ফল। পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে সামাজিক রীতি-আচার শেখানো, সাংস্কৃতিক রুচি ইত্যাদি আরোপ করার প্রবণতাও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। কিশোরীদের পোশাক, নারী-পুরুষ সম্পর্ক, ধর্ম-সম্প্রদায়গত রীতি-আচার ইত্যাদি বিষয়ে পাঠ্যবইয়ের অনেক বিষয় নিয়ে কখনো কখনো বিতর্ক ওঠে। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত অতি সম্প্রতি দশম শ্রেণির গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বইয়ের একটি অধ্যায়ে কোন আকৃতি ও কোন বর্ণের মেয়ে কেমন পোশাক পরবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়া, ষষ্ঠ শ্রেণির একটি বইয়ে কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন দৈহিক পরিবর্তন নিয়ে সংকোচ দূর করতে ‘উপযুক্ত পোশাক পরিধানের’ সুপারিশ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের পর নাগরিক সমাজে ব্যাপক আপত্তি উঠেছে । এর আগে ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের চাপে পাঠ্যপুস্তকে ব্যাপক রদবদলের অভিযোগ নিয়েও বেশ আপত্তি উঠেছিল।

এগুলো বন্ধ করা প্রয়োজন। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, সর্বজনীন মানবিক মূল্যবোধ, নারী-পুরুষ, ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষ সবার সমান অধিকারের স্বীকৃত আইনকানুন ও রীতিনীতির সঙ্গে বিরোধাত্মক ও পশ্চাৎ–মুখী চিন্তাভাবনা, রুচি ও সূক্ষ্ম রাজনীতি থেকে পাঠ্যবইগুলোকে মুক্তি দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।