আমরা তাহলে বাঁচব কীভাবে?

ধরুন কোনো দুর্ঘটনায় আমাদের কেউ আহত হলেন। তাহলে তো শুধু দেহ ভাঙে না, মনও ভাঙে। এই ভাঙা মন জোড়া দেওয়ার প্রয়োজন অনেক হাসপাতালের ডাক্তারদের হয়তো মনে থাকে না। এক্স-রে, ব্যান্ডেজ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে বেশির ভাগ রোগীকে বাসায় ফিরতে হয়। চিকিৎসক হয়তো মনে করেন তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব শেষ। কিন্তু এরপরও যে রোগীকে স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার উপযোগী করে তোলার জন্য বিভিন্ন পুনর্বাসন-পেশাজীবীর চিকিৎসা নেওয়ার ব্যবস্থা করা বা পরামর্শ দেওয়া দরকার, সেই কাজটুকু থেকে যায়। ফলে রোগীর ভাঙা হাত জোড়া লাগলেও ভাঙা মনটা জোড়া লাগে না। তিনি সহজে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন না।

বিভিন্ন দুর্ঘটনা বা কঠিন রোগ, স্ট্রোক প্রভৃতির কারণে মানসিক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। যাকে আমরা পরিচিত ইংরেজি ভাষায় বলি মেন্টাল ট্রমা। অথবা কারও হাত-পায়ের ভাঙা হাড় জোড়া লাগল, কিন্তু তারপরও তিনি এককদম হাঁটতেও পারেন না। অথবা নিজ হাতে জামা পরে বোতামটা লাগাতে পারেন না। তাহলে কি তিনি পুরোপুরি সুস্থ হলেন? না।

স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের পর পুনর্বাসন পেশাজীবীদের সেবা গ্রহণ কারও কারও জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। পুনর্বাসন সেবা যে স্বাস্থ্য চিকিৎসারই অংশ, সেই উপলব্ধি সব হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ ও ডাক্তারদের সক্রিয় বিবেচনায় থাকতে হবে। কেউ হয়তো আপত্তি করবেন না। আবার অনেকেই বলবেন, এটা আর নতুন কী? স্ট্রোক হলে প্রাথমিক জরুরি চিকিৎসা শেষে ফিজিওথেরাপির পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে রোগীর ভাঙা মনও জোড়া লাগে। অর্থাৎ তিনি মনোবল ফিরে পান।

কথাটা ঠিক। ফিজিওথেরাপির চল কিছুটা আছে। তবে আরও অনেক ক্ষেত্রে, পুনর্বাসন-পেশাজীবীর বিশেষ ধরনের সেবা গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে ওঠে। সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। স্বাস্থ্যসেবা ও পুনর্বাসন পেশাজীবীদের কার্যক্রম একীভূত করার প্রতি আরও গুরুত্ব দিতে হবে। এ দুয়ের মধ্যে সংযোগ উন্নত বিশ্বের প্রায় সব দেশেই রয়েছে। এই ক্ষেত্রে বিশ্বমানের চেয়ে আমরা যতটা পিছিয়ে আছি (গ্লোবাল গ্যাপ), তা কমিয়ে আনার জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন করেছে। সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই আইনের কার্যকর প্রয়োগের বিধি ও কর্মপরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে।

২২ জানুয়ারি ২০১৯ প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন পেশাজীবীরা একীভূত সেবার ভূমিকার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁরা বলেন, সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে বিরাট অর্জন। এই পদক্ষেপ বিশেষভাবে গরিব প্রতিবন্ধীদের জন্য বিরাট সুবিধা এনে দিয়েছে। এ গোলটেবিল বৈঠকে সহযোগী ছিল হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যানিটি অ্যান্ড ইনক্লুশন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সংগঠনগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কয়েকটি এলাকায় কাজ করছে। তাদের কিছু গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনালের সমন্বয়কারী মো. মাজেদুল হক ও প্রকল্প ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা। তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামের গরিবেরা স্বাস্থ্যসেবা যদিওবা কিছু পায়, পুনর্বাসন সেবা পায় একেবারেই কম। এই সেবা পেতেও অনেক সময় চলে যায়।

পুনর্বাসন সেবা পাওয়ার পথে তিন ধরনের সমস্যা রয়েছে। বিশেষজ্ঞের সংখ্যা কম। এ তো গেল এক দিক। অন্যদিকে আহত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের লোকজনের সচেতনতার অভাব। তাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য থাকে না। আর তৃতীয় সমস্যাটি হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ও সেবাদানকারীদের সঙ্গে পুনর্বাসন সেবাদানকারী পেশাজীবীদের সমন্বয়ের অভাব। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো দরকার। গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা বিভিন্ন সমস্যা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন।

ধরুন পোশাকশিল্প কারখানার একজন নারী কর্মী কাজ করার সময় দুর্ঘটনায় হাতে আঘাত পেলেন। অথবা সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হলেন। এরপর তিনি ও তাঁর পরিবার যে কী ভীষণ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েন, সে কথা আমরা সবাই জানি। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের পরিবার তো একেবারে পথে বসেছে, আর যাঁরা বেঁচে গিয়েও ধুঁকে ধুঁকে মরছেন, তাঁদের কথা একবার ভাবুন। হাসপাতালে কিছু চিকিৎসা হয়তো হয়েছে। কয়েক দিন হয়তো নামকাওয়াস্তে ফিজিওথেরাপি সেবা পেয়েছেন। কিছু আর্থিক সাহায্যও পেয়েছেন। কিন্তু তাঁরা যে আতঙ্ক, মনঃকষ্ট, ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনায় ভুগছেন; তার কি কোনো কিনারা হয়েছে? তাঁদের মধ্যে কতজন আগের পেশায় ফিরে যেতে পেরেছেন? কতজনকে যত্ন করে পুনর্বাসন সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে?

অথচ আমাদের দেশেই ফিজিওথেরাপির পাশাপাশি রয়েছে অকুপেশনাল থেরাপি, যার কাজ হলো দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও বিশেষ চিকিৎসাসেবা দিয়ে কিছু ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার কোনো ব্যক্তিকে তাঁর কর্মক্ষেত্রে আবার ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা। আছে স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি, যা বাক্‌প্রতিবন্ধীদের কিছু মাত্রায় কথা বলতে ও কর্মক্ষম করে তুলতে পারে। এ রকম আরও পুনর্বাসন কার্যক্রম রয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী আহত ব্যক্তিরা যদি এই সেবাগুলো যথাসময়ে পান, তাহলে ওদের অনেকে এখন সুস্থ, প্রায় স্বাভাবিক জীবন নিয়ে নিজ পেশায় ফিরে যেতে পারেন। অন্তত কিছু কাজ করে খেয়ে-পরে বাঁচার সুযোগ হয়।

এ জন্য দরকার স্বাস্থ্যসেবা ও পুনর্বাসন পেশাজীবীদের সেবার মধ্যে সঠিক সমন্বয়। একটা অভিজ্ঞতা দেখুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একজন শিক্ষার্থী আমাদের প্রথম আলো পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। পুরোদস্তুর চাকরি করতেন না, তিনি ছিলেন প্রদায়ক। কয়েক বছর আগে দায়িত্ব পালনের সময় হঠাৎ দুর্ঘটনায় তাঁর দুটি পা-ই হাঁটু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ অবস্থায় প্রথম আলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় তাঁর কৃত্রিম পা সংযোজন করা হয় এবং তিনি আবার কর্মক্ষম হয়ে ওঠেন। তাঁকে প্রথম আলো চাকরিতে নিয়োগ দিয়েছে। তিনি এখন প্রথম আলো অনলাইন বিভাগের সাংবাদিক। আস্থার সঙ্গে কাজ করছেন।

বিষয়টি আমরা কীভাবে দেখব? নিশ্চয়ই এখানে পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসা, ফিজিওথেরাপি, মনোচিকিৎসাবিদদের সেবা, কৃত্রিম পা সংযোজন সেবা (প্রস্থেটিকস অ্যান্ড অর্থোটিকস)-এদের সবার সমন্বিত সেবার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। আমরা তো এটাই চাই। প্রতিবন্ধীদের জন্য স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন পেশাজীবীদের একীভূত সেবা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চলুক। তাহলে সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবায় এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা আরও বেশি সাফল্য অর্জন করব।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক