হায় আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল!

চার দেয়ালে বন্দী তাঁর জীবন তাঁর প্রাণশক্তি শেষ করে ফেলেছিল কি? ছবি: সংগৃহীত
চার দেয়ালে বন্দী তাঁর জীবন তাঁর প্রাণশক্তি শেষ করে ফেলেছিল কি? ছবি: সংগৃহীত

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল মারা গেছেন! তার দুদিন আগে মোবাইলে আমাদের বার্তা বিনিময় হয়েছে। অপেক্ষায় ছিলাম, আবার একদিন যাব দেখা করতে। জীবন পদ্মপাতায় জমে থাকা এক বিন্দু জলের মতো! টুপ করে কখন যে ঝরে পড়বে, আমরা সেটা আগে থেকে জানতে পাই না।

গত ৯ নভেম্বর দেখা করার পর থেকে ‘সুপ্রভাত’ জানাতাম। আফতাবনগরের ওই বাসায় বুলবুল ভাইকে দেখে বিষাদ হয়েছিল। দিনের শুরুতে আমি তাই বুলবুল ভাইকে শুভর বার্তা জানাতাম। উত্তরে তিনিও সুন্দর দিনের স্নেহাশিস পাঠাতেন। মারা যাওয়ার আগে দুদিন আর আমার এসএমএসের উত্তর দেননি। কেন? অসুস্থ ছিলেন?

এখন যে প্রামাণ্যচিত্রের কাজ করছি, তাতে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল চরিত্র হিসেবে ছিলেন। সেই জন্যই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ। চিত্রধারণের সময় ঠিক আমি একদিন গিয়েছিলাম সেই বাড়িতে, যে বাড়িতে তিনি মারা গেছেন। ফোনে বলেছিলেন, ওটা তাঁর স্টুডিও।

আফতাবনগরের ওই দিকটাতে এর আগে কখনো যাইনি। গিয়ে দেখি, আফতাবনগর এখনো নির্মীয়মাণ। রাস্তাঘাট তৈরি হয়নি। এবড়োখেবড়ো ইটের ওপরে টর্চের আলো ফেলে ফেলে প্রতি মোড় পেরোনোর আগে ঠিকানা মিলিয়ে নিয়ে পৌঁছেছিলাম বুলবুল ভাইয়ের কাছে।

গেটে বাড়ির প্রহরী আমাকে আটকাল না। ফ্ল্যাটের কল বেল না বাজাতেই সুঠাম দেহের এক যুবক হাসিমুখে দরজা খুলে বললেন, আসেন। ঢুকে দেখি, পোশাক পরা তিন পুলিশ সদস্য অস্ত্র হাতে বসে আছেন। বুঝলাম, এঁরা বুলবুল ভাইয়ের নিরাপত্তারক্ষী। যিনি দরজা খুলেছেন, তিনি আমাকে সরাসরি বুলবুল ভাইয়ের ঘরে নিয়ে গেলেন।

ঘরের দুদিকে জানালা। ওপর থেকে নিচ লাল-সবুজ দুই রঙা ভারী পর্দায় ঢাকা। ঘরের প্রায় পুরোটাজুড়ে কম্পিউটার, স্ট্যান্ডের ওপর সেট করা মাইক্রোফোন। একদিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা একটি ট্রেডমিল। অন্যদিকের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে খাড়া করে রাখা সিঙ্গেল সাইজ একটা ম্যাট্রেস।

বুলবুল ভাই বসে আছেন ব্যায়াম করার একটা সাইকেলের ওপর। তিনি ব্যায়াম করছিলেন না। তিনি সাইকেলকে চেয়ার হিসেবে ব্যবহার করছিলেন।

ঘণ্টা তিনেক ছিলাম সেদিন। দেশ, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং তারপর এখন এই চার দেয়ালে বন্দী তাঁর জীবন নিয়ে অনেক কথা বললেন। শুনলাম, এই বাড়িতে ছয় বছর ধরে আছেন। স্টুডিওর ওই ঘরেই ঘুমান। পাশের ঘরে তাঁর ছেলে। জানালেন, সরকার থেকে পাওয়া সশস্ত্র দেহরক্ষীদের নিয়ে ছেলেসহ তিনি ঘরেই থাকেন। কোনো খোলা জায়গায় যান না। দু–এক সময় ছেলেকে নিয়ে যান হোটেল পূর্বাণীতে। যান এমন জায়গায়, যেখানে চার দেয়ালের আড়াল আছে, যেখানে রক্ষীরা শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারবে। মাঝেমধ্যে কলকাতা যান ছেলেকে নিয়ে, হাঁটাহাঁটি করতে। বললেন, এই রকম করে থাকতে চাননি বলে স্ত্রী এখন ইংল্যান্ডে থাকেন। সবটা শুনে আমার ভেতরে খারাপ লাগা তৈরি হতে লাগল।

সংগীতজ্ঞ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশে চলমান আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের মামলায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের একজন। সাক্ষ্য দেওয়ার পর তাঁর ছোট ভাই খুন হন। তারপর থেকে তিনি খোলা জায়গায় আর যেতেন না। অস্ত্রধারী তিন রক্ষীর নিরাপত্তাবেষ্টনীর জীবন আটকে রেখেছেন। আমি একটু অবাক হলাম। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউশন টিমের কোনো কোনো সদস্যকে চিনি। তাঁরা তো স্বাভাবিক সামাজিক জীবনই যাপন করেন! মনে মনে ভাবলাম, বুলবুল ভাই কি জীবননাশের ফোবিয়ায় ভুগছেন?

যা হোক, সেদিন অনেক কথা হলো। কিন্তু তিনি আমার ছবির জন্য সময় দিলেন না। কারণ, সাক্ষ্য দিতে গিয়ে ভাইকে হারিয়েছেন, বাড়িছাড়া হয়েছেন, এখন ঘরে বন্দী, সামাজিক জীবন গেছে, স্ত্রী প্রবাসে চলে গেছেন, পেশাগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেক হয়েছে। আর না। জিজ্ঞেস করলাম: সাক্ষ্য দিয়ে অনুতাপ করেন? উনি বলেন, না। কিন্তু ওটা নিয়ে আর কথা বলব না।

বুলবুল ভাই ধ্বস্ত জীবন কাটাচ্ছেন তখন। বাসাটাও শ্রীহীন। কিন্তু ওনার কথায় দীনতা নেই, ব্যবহারে ঊনতা নেই। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার অহম তাঁর ব্যক্তিত্বে। মৃদু কিন্তু দৃঢ় তাঁর উচ্চারণ।

ততক্ষণে মনে মনে আমি এই গুণী সুরকার, অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা, বর্তমানের মানুষ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে নিয়ে একটা প্রামাণ্যচিত্রের পরিকল্পনা করে ফেলেছি। বললাম তাঁকে। তিনি বললেন, একটু ভেবে তোমাকে জানাই।

দশম শ্রেণির ছাত্র, পনেরো কি সাড়ে পনেরো বছর বয়সী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধে বেশ কয়েকবার পাকিস্তানিদের হাতে আটক হয়েছেন, নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে দৈবক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচেছেন। কোনো প্রশিক্ষণ পাওয়ার আগেই চার বন্ধু মিলে পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর গ্রেনেড ছুড়ে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। স্বাধীন দেশে তিনি সংগীতকে অবলম্বন করে জীবন যাপন করেছেন। কালজয়ী সব গান লিখেছেন, সুর করেছেন। অতুলনীয় সংবেদনে স্বদেশ চেতনায় ঋদ্ধ করেছেন বাংলা গানকে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তাঁর সবিস্তার সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার প্রধান আসামি গোলাম আযমের সাজা হয়। সাক্ষ্য দিয়ে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তারপর থেকে জীবন তাঁর কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে। বুলবুল ভাই সেদিন বলেছিলেন, মগবাজারে ২০ বছর ধরে থাকা বাড়ির মালিক কীভাবে তাঁকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন। তারপর বাড়ির মালিকদের অনেকেই তাঁকে বাড়ি ভাড়া দিতে চাননি। আফতাবনগরের এই বাড়ির মালিক প্রবাসী। কোনো এক পরিচয়ের সূত্রে তিনি একটি ফ্ল্যাট বুলবুল ভাইকে ভাড়া দিয়েছিলেন।

নিরাপত্তাহীনতা তাঁকে এক ঘূর্ণিচক্রের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। জীবনাশঙ্কা জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহ থেকে তাঁদের বঞ্চিত করেছে। এই বঞ্চনায় ক্ষোভ ছিল তাঁর। কিন্তু মানুষকে তিনি ক্ষোভ জানাতেন না। ফেসবুকে ওনার পোস্টগুলোয় দেশপ্রেম পেতাম, পেতাম মানুষের জন্য তার নিরন্তর শুভকামনা।

একরাশ বিষাদ নিয়ে তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি সেদিন। সম্ভবত এই বিষাদই আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র বানানোর ইচ্ছে গাঢ় থেকে গাঢ়তর করে। প্রায় প্রতিদিন সকালে বুলবুল ভাইকে সুপ্রভাত জানিয়ে এসএমএস পাঠাতে শুরু করি। বুলবুল ভাইও উত্তর দিতেন। আরেক দিন দেখা করতে চাইলে সময় করে জানাবেন বলে জানিয়েছিলেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার পর তাঁর ভাই অজ্ঞাতনামা খুনির হাতে প্রাণ দিয়েছেন। আরেক সাজা পাওয়া যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার একজন সাক্ষীও বেঘোরে প্রাণ দিয়েছেন। সাক্ষীদের আরও অনেকে হয়তো জীবননাশের শঙ্কায় জীবন কাটাচ্ছেন। তাঁদের শঙ্কাময় জীবনের খোঁজ কে আর রাখে!

গণহত্যার বিচার করে, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সাজা দিয়ে পৃথিবীর মানবাধিকারের ইতিহাসে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। পৃথিবীর আর কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ আদালতে সাজাপ্রাপ্ত আসামি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারে না। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করে শুনানি শেষে সাজা পাওয়া আসামির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করছেন। কিন্তু এই আদালত সাক্ষীদের নিরাপত্তায় কোনো বিধি-বিধানের ব্যবস্থা করেননি। যাঁদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত অপরাধের অপরাধীদের বিচার হলো, তাঁদের নিরাপত্তার জন্য সাক্ষ্য আইন পাস হলো না।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এখনো চলমান। তবে কেন প্রস্তাবিত সাক্ষ্য আইন পাস করে সাক্ষীদের জানমাল রক্ষায় আমাদের রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে না?

প্রায় গৃহবন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মৃত্যু আমাদের সাক্ষ্য আইন তৈরির প্রক্রিয়াকে বেগবান করবে—এটাই প্রত্যাশা করি।

শান্তিতে থাকবেন, বুলবুল ভাই। এখন যেখানে আছেন, সেখানে সুন্দর থাকবেন।

ফৌজিয়া খান: স্বাধীন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা।